চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিএনপির নির্বাচন প্রস্ততি ও সরকারের উৎকন্ঠা

খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে যে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছেন সেটা আগামী নির্বাচনে বিএনপির ইশতেহার। কেননা যে লেখাটা তিনি পড়েছেন সেখানে বিভিন্ন সেক্টর ধরে তার ভাষায় অনিয়ম, অব্যবস্থা তুলে ধরেছেন, বিএনপি সেসব নিরসনে কী করবে তাও বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো তারা এখন যেখানে আছেন সেই অবস্থান থেকে তারা এসব করতে পারবে? না।

এ জন্য তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে। সেজন্য তার দলকে ভোটারদের মন জয় করতে হবে, ভোটে জিততে হবে। ভোটে বিজয়ী হতে তিনি রাষ্ট্রের প্রতিটা বিষয়ে সরকারের কাজের মূল্যায়ন করেছেন-নিজের দলের পরিকল্পনার কথা বলেছেন।

তার সেই প্রতিশ্রতির মূল্যায়ন পরে আলোচনা করবো। ১০ মে সংবাদ সম্মেলনের পরে স্পষ্ট হয়েছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে, তারা প্রচারণায় এগিয়ে আছে বলে আমরা এতোদিন খবর পাচ্ছিলাম। এবার বিএনপি ও জানিয়ে দিলো তারাও নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছে, তারা নির্বাচনে যাবে এবং ভেতরে ভেতরে অনেকদূর এগিয়েছে।

তারা ভোটারদের কে আকৃষ্ট করার জন্য কৌশল ও ঠিক করে ফেলেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও এবার তারা নির্বাচন বর্জন করবে না। নির্বাচনে যাবে। তারা ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করবে?
সেটা কাল দলের প্রধান বলে দিয়েছেন।

খালেদা জিয়ার সেই বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগ যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেটা বেশ মজার। দলের প্রায় সব নেতা- মিত্র- মন্ত্রী হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন?  তারা এতোদিন বলেছে, বিএনপি নিঃশেষ, তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তাহলে যে দলটি নিঃশেষ তারা কী বলছে এটা নিয়ে শাসকদল এতোটা নার্ভাস কেন?

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে তার আগে দেখি বিএনপি কি করবে বা  আসলেই করবে কী না?
বিএনপি আগামীতে পাওয়ারে গেলে যা যা করবে বলেছে পাওয়ারে থাকার সময় সে এগুলোর কিছুই করেনি। তারা ৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করবে বলছে, কিন্তু এটা আগের নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় গেলেও সেটা বাতিল করেনি। যে নির্বাচনে তারা পাওয়ারে গেছে।

তারা প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতার কথা বলছে, কিন্তু সেই ক্ষমতা কি বেগম খালেদা জিয়া ভোগ ও প্রয়োগ করেননি? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার সময়ে বিকলাঙ্গ করে রাখা হয়নি? পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সে সময়ের দুর্নীত দমন ব্যুরো কি তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে? শ্রমিক- কৃষককে তার দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার কারনে চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি?

দেশের সংখ্যালঘু, আদিবাসীকে তাদের সময়ে কম নির্যাতিত হয়েছে? রাষ্ট্রপতির মতো সাংবিধানিক পদকে দলীয় কাজে ব্যবহার করতে না পারার কারনে রাষ্ট্রপতিকে অবমানাকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি? আবার দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেরভার তারা কি আরেক রাষ্ট্রপতির কাঁধে তুলে দেয় নি?

তারা বিচার বহির্ভুত হত্যা বন্ধের কথা বলেছে। অথচ অপারেশন ক্লিনহার্ট তো বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ছিলো। যেটা তারা সংসদে আইনী বৈধতা দিয়েছে। সংসদ কার্যকর করার কথা বলছে, সংসদীয় কমিটি নিয়ে প্রতিশ্রুতি আছে। অথচ ২০০১ সালে নির্বাচনে সরকার গঠনের পরে সংসদীয় কমিটি করতে তাদের আড়াই বছর সময় লেগেছে। তারা সংখ্যানুপাতে সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীদলের সদস্যদের দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেটা এখন বলবৎ আছে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদীয় কমিটি করে বিএনপিকে দুটো সংসদীয় কমিটির সভাপতি করেছিল। যার একটা ছিলো মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। যার সভাপতি হয়েছিলেন নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত আশরাফ উদ্দিন নিজান। ফলে এটা নতুন ভাবনা নয়।

রাষ্ট্র পরিচালনার যে আবর্জনা পরিস্কারের কথা বলছে বা সংস্কারের কথা তারা বলছে তার অনেক জঞ্জাল তাদের রেখে যাওয়া। কালকের ঘোষণায় বিএনপির মৌলিক একটা দাবি থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত আছে, তা হলো কেয়ারটেকার ব্যবস্থা নিয়ে।

ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এতোদিন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার যে দাবি তুলেছে বা দশম সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু কালকের ঘোষণায় সেটা পুনর্বহাল এর কোন প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গিকার নেই। গনতন্ত্র প্যারার ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,” আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে সংবিধানের পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনীর গনভোট ব্যবস্থা বাতিল, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল, সংবিধানের কিছু বিষয়ে সংশোধন বিয়োজন করে,উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসন এর ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যাস্তকরনের বিধান সহ কয়েকটি অগনতান্ত্রিক বিধান প্রনয়ন করেছে। বিএনপি এগুলো পর্যালোচনা, পুনঃ পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে”।

লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো তাদের মূল রাজনৈতিক দাবি কেয়ারটেকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি এখানে নেই। যদিও দেশে গত কয়েক বছর রাজনীতি বা রাজপথের সহিংসতা হয়েছে এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে। তারা ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আগের আওয়ামী লীগ সরকারে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু এখন বলছে সেগুলোর সেবার মান বাড়াতে পদক্ষেপ নেবে।

তারা বিচার ব্যবস্থাকে দলীকরন মুক্ত করার কথা বলছে অথচ বিচাপতিদের বয়স বাড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া, দলীয় নেতাকে বিচারপতি বানানো ( বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহবায়ক কাজী এটি মনোয়ার উদ্দিনকে বিচাপতি পদে নিয়োগ দেয়া, যিনি তার সরকারী বাসভবনে ছাত্রদলের সভাপতিকে পাশে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ব্যপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন) এবার তারা সেটাকে কার্যকরের কথা বলছে।
২১১ টি প্রতিশ্রুতির প্রতিটি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করলে স্ব-বিরোধীতা পরিস্কার হবে।

আবার সবগুলো পড়লে বোঝা যাবে এ সব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলো পালন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ বিএনপির এই স্ব- বিরোধীতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনার দিকে না গিয়ে তারা এটা কেন প্রণয়ন করা হলো বা হচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমনকি তাদের ভিশন ২০২১ এর অনুকরনে ভিশন ২০৩০ প্রনয়ন মেধাস্বত্ব আইনের বরখেলাপ বলতে চাইছে।

ভিন্ন ভিন্ন দলের পক্ষে রাজনীতিতে একই ধরনের প্রতিশ্রতি বা অঙ্গীকার একই সময়ে বা আগে পরে দেবার বহু নজির এদেশে আছে। ৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোট তাদের আলাদা মঞ্চ থেকে অভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কাজেই এখানে মেধাস্বত্ব দাবি অমূলক।

দেখা যাচ্ছে আওয়ামীলীগ বিএনপির প্রতিশ্রুতির বিষয়ে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে জবাব দিচ্ছে না। অনুমান করছি, আওয়ামীলীগ মানুষের প্রত্যাশার মিটারের পারদের ওঠানামা দেখতে পাচ্ছে।

দেশে নানা সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, সুশাসনের অভাব তীব্রতর হচ্ছে। মানুষ ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। সরকারী দলের কিছু নেতা কর্মীর আচরনে সাধারন মানুষ বিরক্ত যা মাঝে মাঝে তাদের নেতাদের কাছ থেকেও আমরা জানতে পারছি।

ইতিহাস বলছে বিএনপি সুশাসন দিতে পারেনি আবার আওয়ামীগ ও পারছে না অনেক সময় চেস্টা ও করছে না। কখনো কখনো তারা সাধারন মানুষের আকাঙ্খার বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে। আবার তৃতীয় কোন ধারার অনুপস্থিতি মানুষের এই ক্ষোভকে বিএনপি মুখী করতে পারে। একথা বিএনপি ও স্বীকার করবে তারা দলীয় প্রধান বা দলের বড় কয়েকজন নেতার মামলার বিষয়ে কথা বলা ছাড়া জনগনের সংকট নিয়ে কখনো কিছু বলেনি। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে অতীতের নানা খারাপ কাজের উদাহরনের সাথে দলটির সম্পৃক্ততা থাকার পরেও মানুষ তাদের বেছে নিচ্ছে। নারায়নগঞ্জ সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা গেল তাদের প্রার্থী অপরিচিত হলেও তিনি প্রায় ১ লাখ ভোট পেলেন।

অর্থাৎ বিরক্ত- ক্ষুব্ধ মানুষ সরকারে উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বিএনপিকে বেঁছে নিচ্ছে। অনেকে ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপির নেতিবাচক কাজকে মনে রাখেননি বা যে ভোটারটির বয়স এখন ২০ বছর সে অনেক কিছু জানেই না। সে চোখের সামনে দেখছে,দেশে ধর্ষন- খুনের বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে , দুস্টের লালন করা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের পরিচয় ব্যবহার করে অনেকে অবৈধ পথে বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছে, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দিতে, চাকরিতে নিয়োগ পেতে সরকারের লোকজন কোথাও কোথাও জবরদস্তি করছেন।

১০ মে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পরে শাসকদলের অনেক নেতা- কর্মীর কথার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা দেখছি। তারা কি অনুমান করছে মানুষের বিশেষ করে বিপুল সংখ্যক তরুনের ক্ষোভ কেবল ম্যাক্রো লেভেলের কিছু উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে ভোট আদায়ের কৌশল সফল নাও হতে পারে। না হলে যে কাজ বিএনপি ক্ষমতায় থেকে করেনি সেটা ভবিষ্যতে করার প্রতিশ্রতি দিচ্ছে স্রেফ ভোটারদের প্রলুব্ধ করতে সেটা না বলে এরা বালখিল্য আচরন করছেন কেন?

বুঝতে পারি, বিপুল মানুষের সমর্থনকে অবজ্ঞার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে এই অস্থিরতা, বালখিল্য আচরণ।

বহু সময় ফুরিয়েছে তবুও শিক্ষা নিন।
কাজে লাগবে- কাল বা পরশু।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)