বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্মঅম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে দেশ বিভাগোত্তর ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে হওয়া আন্দোলনের চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে।
মাতৃভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও তার যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা পৃথিবীর বুকে অনন্য। কারণ বিশ্বে এ যাবতকালে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
কী ঘটেছিল সেদিন?
ওইদিন (১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্র-যুবক হতাহত হন। সেদিন শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার প্রতিবাদে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নানা নির্যাতনের পরও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে।
ছাত্রদের আন্দােলনের পাশাপাশি পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকেন। একই সময়ে সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের সদস্যদের সভাস্থল ঘিরে রাখে পুলিশ।
এর ২ ঘণ্টা পর ছাত্ররা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে তাদের সতর্ক করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এসময়ে কিছু ছাত্র বের হতে পারলেও অনেকে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানালেও ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে। ছাত্রদের গ্রেফতারের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
বেলা ২টার দিকে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। ছাত্ররা প্রথমে আইন পরিষদের সদস্যদের আইনসভায় যোগ দিতে বাধা দিলেও পরে সিদ্ধান্ত নেয় তারা (ছাত্ররা) আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে।
কিন্তু ছাত্ররা আইনসভার দিকে রওনা করলে ৩টার দিকে পুলিশ ছাত্রাবাসে ঢুকে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছরেরে কিশোরসহ নিহত হয় আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে।
ছাত্রদের হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের আন্দোলন জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। দ্রুত ভূমিকা নেয় সংস্কৃতি জগতের লোকজনও। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।
গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চললেও পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।
২২ ফেব্রুয়ারি এবং পরে যা ঘটেছিল
২১ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাওয়ার অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের জন্য অধিবেশন স্থগিতের কথা বলেন। নুরুল আমিন তাদের অনুরোধ না রাখায় তারা রাগে ফেটে পড়েন।
২২ তারিখে আইন পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যরা বিষয়টি উত্থাপন করেন। এদিনও তারা নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণার আহ্বান জানান। এদিন ক্ষমতাসীন দলের কিছু সদস্যও এই আহ্বানে সমর্থন জানান। কিন্তু নুরুল আমিন তাদের আহ্বানের সাড়া না দিয়ে অধিবেশন অব্যাহত রাখেন এবং হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে মিছিল ও বিক্ষোভে সারা উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে সাধারণ জনগণ। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়।
২২ তারিখ বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।
বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্রের প্রেস অফিসে আগুন দেয়।
ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তখন থেকে প্রতি বছর এ দিনটি জাতীয় ‘শোক দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাধিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে।