‘এল ক্লাসিকো’ বিশ্ব ফুটবলের সেরা যুদ্ধ। যুগের পর যুগ যে ম্যাচ উপহার দিয়ে এসেছে নানা রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। রোববার আবারো সেই দিন। স্পেন দ্বিখণ্ডিত হবে, দ্বিখণ্ডিত হবে পুরো ফুটবল বিশ্ব, উত্তেজনায় কাঁপবে ফুটবলপ্রেমীরা। এক দিকে রাজকীয় রিয়াল মাদ্রিদ, অন্যদিকে কাতালুনিয়ার প্রিয় বার্সেলোনা। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর এই ধুন্ধুমার লড়াইতে রিয়াল অনেকটা নির্ভার থাকলেও বহু হিসেব কষেই মাঠে নামতে হচ্ছে বার্সাকে। ম্যাচটি শুরু হবে রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে।
গত কয়েকটি মৌসুমে চেনা ছবি ছিল একটাই, ‘এল ক্লাসিকো’ মানেই লিওনেল মেসি বনাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর লড়াইয়ের সরাসরি ‘অ্যাকশন’। তবে সে চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। ‘বার্নাব্যুর’ মহারণে বার্সেলোনার ‘রাজপুত্র’ আর রিয়াল মাদ্রিদের ‘মিসাইল’ই শুধু নন, এখন লড়াই হয় ত্রিফলার।
মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ বনাম রোনালদো-বেনজেমা-বেল। কে কাকে ছাপিয়ে যেতে পারেন সেই যুদ্ধ। তাই নিয়ে ফুটবল দুনিয়ার আগ্রহ তুঙ্গে। ক্লাসিকোর রাতে এখন ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকারও যুদ্ধ। বার্সা হয়তো নিষেধাজ্ঞায় থাকা নেইমারকে পাচ্ছে না। তবে তারা ক্রীড়া আদালতে আপিল করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে চোট কাটিয়ে ক্লাসিকোতে ফিরছেন বেল, খবর এমনটাই। দুদলে বাকি চারজন থাকছেন যথারীতি। তাই এবারের লড়াইটা দুদলের ত্রিফলার লড়াই হবে না হয়তো। এমএসএন আর বিবিসির মধ্যে কেউ না কেউ থেকে যেতে পারেন লড়াইয়ের বাইরে।
অনেকটা নির্ভার হয়েই ঘরের মাঠে ক্লাসিকোতে নামবে রিয়াল। এক ম্যাচ কম খেলে বার্সার চেয়ে তিন পয়েন্ট এগিয়ে স্প্যানিশ টেবিলের শীর্ষে তারা। সেইসঙ্গে বায়ার্নের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে জিদানের ও শিষ্যরা।
বার্সার অবস্থা সেখানে রিয়ালের ঠিক বিপরীত। লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে পিছিয়ে তো আছেই, তার ওপর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আসর থেকে বিদায় আর গত কয়েকটি ক্লাসিকোতে সবচেয়ে ধারাবাহিক নেইমারের নিষেধাজ্ঞার খড়গ। সর্বপরি ক্লাসিকোতে নিজেদের সম্মান রক্ষা। সব মিলিয়ে বহু হিসেব কাতালান ক্লাবটির।
ক্লাসিকোতে থাকবে আবেগও। পরের মৌসুমে না থাকার ঘোষণা দেয়ায় কোচ লুইস এনরিকের শেষ ক্লাসিকো হতে যাচ্ছে এটি। প্রথম মৌসুমে ট্রেবল জেতানো কোচের সম্মানজনক বিদায় দেয়ার দায়ও থাকছে মেসি-সুয়ারেজের ওপর।
যুদ্ধটা যতই এমএসএন বনাম বিবিসি হোক, তবুও মেসি-রোনাদলদো দ্বৈরথ নিয়ে আলাদা উত্তেজনা থাকবেই। সবশেষ হিসেব ধরলে এমএল টেনের চেয়ে এগিয়ে আছেন সিআর সেভেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শেষ আটে দুই লেগে মেসি যেখানে গোলশূন্য, সেখানে একটি হ্যাটট্রিকসহ রোনালদো পাঁচ গোল করে একাই দলকে তুলেছেন পরের পর্বে।
তবে ম্যাচটা লা লিগার। সেই হিসেব দেখলে অনেক এগিয়ে আর্জেন্টাইন তারকা। চলতি মৌসুমে লিগে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৯ গোল করেছেন মেসি। রোনালদোর গোল সেখানে ১৯। কিন্তু মেসিকে নিয়ে শঙ্কা একটি বিষয়ে। ২০১৪ সালের মার্চের পর গত ছয়টি ক্লাসিকোতে গোল পাননি তিনি।
এই ছয় ম্যাচে রিয়াল-টনিক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো করেছেন ৩ গোল। যদিও এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসিই। বার্সা-রিয়াল মহাদ্বৈরথে ৩৩ ম্যাচ খেলে ২১ গোল করেছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর।
খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত হিসেবের বাইরে পয়েন্ট টেবিলের সমীকরণ বলছে, রোববারের ম্যাচটি দুই দলের জন্যই মহাগুরুত্বপূর্ণ। ৩১ ম্যাচে ৭৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে রিয়াল। ৩২ ম্যাচে বার্সার পয়েন্ট ৭২। এমন অবস্থায় শিরোপা-স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্বাগতিক রিয়ালের বিপক্ষে জয়ই বার্সার সামনে একমাত্র বিকল্প।
বর্তমান পয়েন্ট টেবিলের মতো ক্লাসিকোর মুখোমুখি লড়াইতেও এগিয়ে রিয়াল। ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দু’দল মুখোমুখি হয়েছে ২৩১বার। যেখানে সাফল্যের পাল্লা ভারী রিয়ালের। বার্সেলোনার ৯০ জয়ের বিপরীতে রিয়ালের জয় ৯৩ ম্যাচে। বাকি ৪৯টি ম্যাচে কোন ফল আসেনি। অর্থাৎ ড্র।
দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বোঝাতে একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। মুখোমুখি লড়াইয়ে ফল আসা ১৮৩ ম্যাচের ৪৩ টিতেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে ২-১ গোলে। যেখানে রিয়ালের জয় ২৩টি ও বার্সেলোনার ২০টি ম্যাচে।
সবদিক থেকেই একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কাতালানরা। সর্বশেষ চার ম্যাচের মধ্যে বার্সা হেরেছে দুটি, আর একটি করে ড্র ও জয়।
দল যে সেরা ছন্দে নেই, সে কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন বার্সা ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে। তবে সেরা ছন্দে না থেকেও রিয়ালকে হারানোর সামর্থ্য বার্সার আছে বলেও জানান তিনি।
পিকে বলেছেন, ‘রোববার আমাদের জন্য খুব বড় ম্যাচ। আমাদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। তবে আমরা যদি সেরা ছন্দে নাও থাকি, তার পরও বিশ্বাস করি সেখানে গিয়ে জিততে পারব।’
বার্সা কোচ এনরিকেও আত্মবিশ্বাসী। বলেছেন এই ম্যাচের ফলই বলে দেবে কে এবারের লিগ টাইটেল ঘরে তুলতে যাচ্ছ। রিয়াস বস এনরিকে আবার উল্টো ভাবছেন। তার মতে এই ম্যাচের ফল লিগের শিরোপা নির্ধারক হবে না। মৌসুমের প্রথম ক্লাসিকোতে ন্যু ক্যাম্প থেকে ড্র করে ফিরেছিল রিয়াল।
হিসেব-যুক্তি, তর্ক-পরিসংখ্যান যাই হোক, খেলোয়াড় বিশ্লেষকরা যে যাই বলুক, এল ক্লাসিকো মানেই সব হিসাব-নিকাশের বাইরে আলাদা রোমাঞ্চ। যার ছোঁয়ায় শিহরিত বিশ্ব ফুটবল।