চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘বাবার কারণেই আজ আমি পুলিশ ক্যাডারে সফল হয়েছি’

খুব সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এক বাবা  মো. আব্দুর রউফ। নওগাঁ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বরুণ কান্দির বাসিন্দা তিনি। ৬ ভাই ৩ বোনের সংসারে এ বাবা সবচেয়ে বড়। আর তাই অন্যান্যদের চেয়ে তার দায়িত্বটাও অনেক বেশি।

ব্যাংক কর্মকর্তা এ বাবার জীবন সংগ্রামের শুরুটা সেই ছোট বেলা থেকেই। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় ছোটতেই ধরতে হয়েছে সংসারের হাল। মা-বাবাসহ ৯ ভাইবোনের ভরণপোষণের সব দায়িত্বই পালন করতেন হাসিমুখে।

প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারি এ বাবার অফিস গ্রাম থেকে অনেক দূরে হওয়ায় রাতভোর হওয়ার আগেই ছুটতে হতো অফিসের পথে। আবার কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরতেন তখনো থাকতো ঘোর অন্ধকার। তবুও অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত-শ্রান্ত বাবা  খোঁজ নিতেন একান্নবর্তী পরিবারের সবার। নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন, তাদের সন্তানসহ নিজের সন্তানদের। কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে পরিচালনা করতেন পুরো পরিবার। সৎ, পরিশ্রমী এই বাবা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে অফিসে গেলেও কষ্ট করতে দেননি  সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে সদা সচেষ্ট এ বাবা।

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত বাবা পড়তে বসাতেন সন্তানদের। সার্বক্ষণিক পড়াশোনার খোঁজ রাখতেন সন্তানদের।সেসময় সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হওয়া ছিলো এক কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। আশপাশে ছিলে না কোন শিক্ষিত মানুষ। সেই অবস্থা থেকে সন্তানদের তুলে এনে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন তিনি। দেখিয়েছেন সঠিক পথের সন্ধান। হয়েছেন অালোর দিশারাী।

তার দু’সন্তানই প্রথম সেই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার গৌরব অর্জন করে। এমনকি সে গ্রামের প্রথম বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বড় সন্তান নাজরান রউফ। দ্বিতীয় সন্তান নাশরত রউফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যয়ণরত। শুধু নিজের দু’সন্তানকেই নয় তিনি শিক্ষিত করে তুলেছেন তার ভাই-বোনদের প্রতিটি সন্তানকে।

আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল  এই বাবার বড় পরিবার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো প্রায়ই। তবুও মনোবল হারাননি তিনি। সবসময় পূরণ করেছেন নিজের সন্তান সহ ভাই বোনদের সন্তানদের সব চাহিদা। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রতিদিনই সন্তানদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে ফিরতেন বাবা। একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিটি শিশুকে ভাগ করে দিতেন তা।

এই বাবার বড় সন্তান নাজরান রউফ ৩৫তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে সারদা পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণে রয়েছেন।

চ্যানেল আই অনলাইনকে বাবার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,  ‘সেদিন আমার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রামের ও পরিবারের সবার আশা ছিলো আমি অনেক ভালো ফলাফল করবো। কিন্তু ফলাফল আশানুরুপ হয়না। অল্পের জন্য অামি এ প্লাস পাইনা। বাসায় ফিরে দেখি সবাই অনেক কান্নাকাটি করছে। মা সেদিন অনেক রাগ করেন। কথা বন্ধ করে দেন আমার সঙ্গে। পরিবারের সবাই তটস্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি বাবার অফিস থেকে ফেরার। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, যে সেদিন বাবা আমাকে একটুও বকা দেননি। বাবা এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বারবার বোঝাতে থাকেন। মন খারাপ করোনা। এবার ফল খরাপ হয়েছে তো কি হয়েছে। ভবিষ্যতে ভালো করবে তুমি ভালোভাবে পড়ো। যখন কেউ পাশে ছিল না তখন বাবাই পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন।’

বাবার এ কথা মনে হলে এখনও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন পুলিশের এই কর্মকর্তা। এসএসসি পরীক্ষার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বাবার সেই অনুপ্রেরণাই তাকে আজ এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন তিনি। ‘বাবার কারণেই আজ আমি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সফল হয়েছি।’

পড়াশোনার বিষয়ে অনেক সচেতন ছিলেন এই বাবা। আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চ ভালো শিক্ষকদের কাছে সন্তানদের পড়ানোর। দিনের পর দিন নিজে এক পোশাক পরে থাকলেও সন্তানদের ঠিকই কিনে দিয়েছেন নতুন পোশাক। প্রতি ঈদে একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য নতুন পোশাক কিনলেও নিজে নেননা কিছুই।

ছোট ভাই-বোনদের, তাদের সন্তানদের বিয়েও দিয়েছেন বাবা। সেক্ষেত্রে যাবতীয় দায়িত্ব  আনুষ্ঠানিকতা সবই পালন করেছেন তিনি।

সন্তানদের অসুস্থ্যতার সময় রাতের পর রাত সন্তানের পাশে বসে থেকেছেন বাবা। নিজ হাতে ওষুধ খাইয়েছেন, গা মুছিয়ে দিয়েছেন। রাতজেগে দিয়েছেন পাহারা।

বর্তমানে জনতা ব্যাংক নওগাঁর মধুইল শাখার ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। সন্তানরা এখন বড় হয়ে যাওয়ায় যে যার মতো অনেক দুরে। সন্তানরা বাবার খোঁজ নিতে ভুলে গেলেও বাবা কখনোই ভোলেননা তার সন্তানদের খোঁজ নিতে। অধীর আগ্রহে বাবা অপেক্ষায় থাকেন কখন তার প্রাণের মানিকদের ছুটি হবে? কবে তারা বাড়ি ফিরবে? সন্তানরা বাড়ি ফিরলেই যেনো পূর্ণতা পায় তার সংসার।