নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান সিজারের মেয়ে আরিয়ানাকে এই প্রথমবারের মতো বাবাকে ছাড়া জন্মদিন পালন করতে হচ্ছে। মেয়ের জন্মদিনে সিজারের অনুপস্থিতি তার পরিবার ও বন্ধুদের কতটা পোড়াচ্ছে, তা জানিয়েছেন সিজারের বন্ধু সাংবাদিক রকিবুল শিপন।
ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন: “দুপুর বেলা হঠাৎ সিজারের ফোন, কি অস্তা শিপন? ও এরকমই। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপের একটা নিজস্ব ঢং আছে ওর। তাই কী অবস্থা অবলীলায় হয়ে যায় ‘কি অস্তা’। দেখা গেলো দুই-তিন মাস কোনো যোগাযোগই নেই, একদিন আচমকা ফোন, ‘কি অস্তা তোর?’ তারপর কিছু খিস্তি-খেউড় এবং আশপাশের দেয়াল কাঁপিয়ে অট্টহাসি।
অই, আইজকা দুপুরে তোর কাম কি? বললাম, ডে অফ আজ। তাইলে এক কাম কর। দুপুরে যমুনায় চইলা আয়। একলগে লাঞ্চ করমু। হেরপর লা লা ল্যান্ড দেখমু দুই বন্ধু মিল্ল্যা।
ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে যমুনায় গিয়ে দেখি খাবার নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। খাওয়ার সময় এটা-ওটা নিয়ে গল্প-হাসাহাসি। এক পর্যায়ে আরিয়ানার কথা ওঠলো। আরিয়ানা মানে ওর পাঁচ বছরের মেয়ে। দেখতে এত কিউট! মনে হয় যেন পুতুল।
তোর মতো নোয়াখাইল্ল্যা পোলার ঘরে এইরকম একটা কিউট বেবি আসলো কেমনে? এই বলে আগে সিজারকে ক্ষেপাতাম আমি। ও হাসতে হাসতে বলতো, ‘ব্যাডা, তুই আসলেই একটা ফাউল।’
আরিয়ানা মায়ের কাছে থাকে। সপ্তাহে একবার, ছুটির দিনে আসে বাবার কাছে। সেই দিনটা সিজারের কাছে ঈদের মতো। আমাদের ঈদ বছরে দুইটা। সিজারের যেন ৫২টা, সপ্তাহে একটা করে।
ওইদিন সারাদিন মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, পছন্দের রেস্টুরেন্টে খায়। খেলনা কিনে দেয়। বাবাকে পেয়ে মেয়েও আব্দারের ডালি মেলে ধরে। বাবাও সেগুলো পূরণ করে ধন্য হয়। এমনকি জলহস্তির মতো ওইরকম ভারি শরীরটা নিয়ে মেয়ের জন্য টাট্টু ঘোড়া সাজতেও কোনো ক্লান্তি নেই তার। বাপ-মেয়ের খুনসুটির ছবি দেখি আমরা সন্ধ্যাবেলায়, ফেসবুকে।
তো খাওয়া শেষে ঢুকলাম সিনেমা দেখতে। রিভিউটা পড়া ছিল। তারপরও যেখানে সংলাপ বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল, সেখানে সিজারের হেল্প নিচ্ছিলাম। বেশ চলছিল। হঠাৎ লাইট জ্বলে ওঠলো, বিরতি। সিজার বললো, ‘তুই বয়, আমি ওয়াশরুমে যামু।’
সিজার বের হওয়ার মিনিট খানেক পর কেন জানি মনো হলো পুরো হলরুমটা দুলছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি আশপাশের লোকজন চিৎকার শুরু করে দিয়েছে, ভূমিকম্প! দ্রুত বের হলাম। ততক্ষণে কম্পন থেমে গেছে। সিজারও ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। ওর হাতে ধরা ফোনটায় আলো জ্বলছে। বললাম, ফোন এসেছে তোর।
ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে আরিয়ানার ভয়ার্ত কণ্ঠ। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। ‘বাবা, কোথায় তুমি? জানো বাবা, কম্প হয়েছে। তুমি আসো প্লিজ। আমার না খুব ভয় করছে।’
সিজারের চোখ ছলছল করছে। প্রচণ্ড চেষ্টায় কোনো রকমে কান্নাটাকে আটকে রেখেছে ও। বললাম, চল। আর সিনেমা দেখতে হবে না। বাধ্য ছেলের মতো আমার পিছু নিলো ও। যমুনা থেকে বের হয়ে পার্কিং লট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম ওকে। এর মাঝে আমাদের মধ্যে আর একটি কথাও হয়নি। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো ও। আমি জানি, বাসায় গিয়ে এখন দরজা বন্ধ করে হু হু করে কাঁদবে।
সেই আরিয়ানার জন্মদিন আজ। মেয়েটা আজকে ছয়ে পা দিচ্ছে। এবং জীবনে প্রথমবারের মতো বাবাকে ছাড়া আজ জন্মদিন পালন করবে ও। গত ৭ নভেম্বর সিজার নিখোঁজ হওয়ার পর আরিয়ানাকে জানানো হয়েছে, বাবা বিদেশে গেছে, পড়তে। তা শুনে ছোট্ট মেয়েটির সে কি অভিমান! বলেছে, কই, বাবা তো বলে গেলো না!
মেয়েটি মনে মনে নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে, আজ জন্মদিনে বাবা তার পছন্দের একগাদা ‘মাই লিটল পনি’ খেলনা নিয়ে হাজির হবে। তাকে ‘সালপাইজ’ দিতেই বাবা হয়তো এতদিন চুপটি করে ছিল। আর যা-ই হোক, বাবা যেখানেই থাকুক, তার জন্মদিনে আসবেই, আসবে। আসলে সে আচ্ছা করে বাবাকে বকে দেবে, আর যেন তাকে না বলে কখনো কোথাও না যায়। কত কথা জমে আছে, বাবাকে বলার জন্য!
কিন্তু ছোট্ট আরিয়ানা তো জানে না, ও থাকে মার্কেজের সেই জাদু বাস্তবের শহরে। যেখানে মাছি থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে থেকেও দিনে-দুপুরে লোকজন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আতঙ্কে তটস্থ থাকে লোকজন, একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়, পাখি কখন জানি উড়ে যায়। যে শহরে মাত্র ১৫শ’ টাকা দিতে না পারায় তিন হাসপাতাল ঘুরে একজন মাকে শেষ পর্যন্ত সড়কের ওপর সন্তান প্রসব করতে হয়, অথচ ঋণের এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েও দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে প্রভাবশালীরা। যে শহরে বানানো পোশাক সারা দুনিয়ার মানুষ গায়ে দিয়ে বেড়ায়, সেই শহরেই শীতের রাতে ছেড়া গেঞ্জি গায়ে কুকুরের পাশে শুয়ে থাকে মানুষ। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও জঙ্গিরা বিলাসবহুল এলাকার দামি রেস্টুরেন্টে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করতে পারে। যে শহরে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হওয়ার পর প্রথমেই মনে হয়, নিরাপদে আবার ফিরতে পারব তো!
সেই জাদুর শহরে বাবার খোঁজে কার কাছে যাবে আরিয়ানা! বাবা না আসলে আজ হয়তো প্রচণ্ড অভিমান করবে মেয়েটা। কান্নাকাটি করবে খুব। বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষে হয়তো না খেয়েই ঘুমাতে যাবে। কিন্তু কার তাতে কি! আমরা তো সামান্য লোক।”