“মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা” আজ পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের প্রথম দিন। নতুন করে নতুন রঙে নতুনের আগমনী বার্তা জানান দিতে পুরনো সব গ্লানি মুছে নতুন একটি বছরকে বরনের শুভ দিন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেয়ার দিন। সর্ববৃহৎ আনন্দময় উৎসব। গ্রাম বাংলার ঘর, মাঠ, প্রান্তর পেরিয়ে এই উৎসব আজ প্রাণের স্পন্দন তুলছে প্রতিটি বাঙালির মনে।
ঢাকা বৈশাখ উদযাপনের প্রধান কেন্দ্র্র। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের সারাদিন রাত মানুষের প্রাণের উচ্ছলতা ও উৎসব আয়োজনের ঐশ্বর্যের কারণে বর্ষবরণের এমন উৎসব পৃৃথিবীতে বিরল। এমন সার্বজনীন উৎসব আর নেই। তবে এ উৎসব উদযাপনে এবারও সরকারি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের নানা ঘোষণা, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এবারও সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে আগে ভাগেই মুখোশ পরা যাবে না। মোটরসাইকেলে ১ জনের বেশি চড়া যাবে না, আওয়াজ করে ভ্যাপু বাঁশি বাজানো যাবে না ইত্যাদি। এতে করে সাধারণ মানুষ স্বাধীন ও অবারিতভাবে উৎসব উদযাপনে কিছুটা হলেও বাধার মুখে পড়ে। নববর্ষের বিভিন্ন আয়োজনে জঙ্গি হামলা, বখাটেদের উৎপাত এসব থেকে পরিবেশ নিরাপদ রাখতে সরকারের এই পদক্ষেপ।
কিন্তু মানুষকে ঘিরে মানুষের জন্যই মানুষের এই বিশাল আয়োজনকে কিছু সীমাবদ্ধতায় আটকে ফেলা নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষও আছে। যা হোক, বিভিন্ন পদক্ষেপ, ঘোষণা ও সিদ্ধান্তের বাহুল্যে কোনোভাবে যেন প্রাণের এই উৎসব উদযাপন বাধাগ্রস্ত না হয় সে দিকটা খেয়াল রাখা উচিৎ। কারণ, বৈশাখ উদযাপনের এই রেওয়াজটি বাঙালির বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত। যুগে যুগে বহু বাধা এসেছে এই উৎসব আয়োজনে। কিন্তু তা রুখে দিয়েই বাঙালি তার প্রাণের উৎসব উদযাপন করেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে জাগ্রত হয় তৎকালীন ছাত্র সমাজ। ১৯৬৫ সালে ‘ছায়ানট’ সংগঠন বাংলা ১৩৭২ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। রমনার বটমূলে বাংলার প্রিয়কবি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গান দিয়ে শুরু হয়।
২০০১ সালে সেই রমনা বটমুলেই আমাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তৎপর গোষ্ঠীর নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারান অনেক মুক্ত প্রাণের মানুষ। কিন্তু তাতে বাংলা বর্ষবরণের তাগিদ, উন্মাদনা বা চেতনা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। দিনে দিনে বর্ষবরণ উদযাপনে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যারা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতায় এই উদসব আয়োজনকে নিয়ে নানা অপব্যাখ্যা করতো, তারাও দিনে দিনে সেই সীমাবদ্ধতার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসছে। নববর্ষে মানুষের উন্মাতাল জাগরণ, প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত বাঙালিয়ানায় মিশে যাওয়ার উৎসব তাই প্রমাণ করে।
ইতিহাস বলছে, সম্রাট আকবর তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোর্তিবিদ আমির ফতুল্লাহ সিরাজীকে হিজরী চন্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রচলন করেন। প্রজাদের খাজনা পরিশোধ ও ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’, মিষ্টিমুখ করা ছিল মূল উদ্দেশ্য। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন আচারানুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে সব হিসেব নিকেশ নতুন করে শুরু করার এই রীতি বাংলা সংস্কৃতির ঐশ্বর্যকে বাড়িয়ে দেয়। বাংলা সন গনণার হিসাবটি মূলত ফসলি হিসেবকে মাথায় রেখে প্রচলিত হয়। আমাদের কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় ফসলি মৌসুম, ঋতু বৈচিত্র, মানুষের অনুভব সবই দারুণ পরিবর্তনশীল ও একটি নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। আমরা দেখি কৃষি ফসল লাভের উপর ভিত্তি করেই কৃষক সমাজ কয়েকটি উৎসব করে থাকে। নবান্ন, পৌষের পিঠা উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, এসব বাংলা সংস্কৃতির অংশ। এর মধ্যে পহেলা বৈশাখ সবচেয়ে বড় উৎসব। বাংলা শিশু-যুবা-বৃদ্ধাসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ এ দিনটিকে বর্ণিল করে থাকে।
ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখা যায় বাংলা সন ইসলামী হিজরী সনের একটি রূপ। মূলত, হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছরের সাথে সময় মিলিয়ে বাংলা পঞ্জিকা তৈরী করা হয়। চন্দ্র বছর ৩৫৪ দিন এবং সৌর বছর ৩৬৫ দিন। অর্থাৎ ১১/১২ দিন কম হয়। চন্দ্র বছরের সাথে ঋতুগুলি এলোমেলো হতে থাকে। ফসলের চাষাবাদ যেহেতু ঋতু নির্ভর তাই বাঙালিকে বাংলা পঞ্জিকা মেনে চলতে হয়। এই মাসগুলো শুরু হয় এবং শেষ হয় রাশি চক্রে সূর্যের অবস্থানের উপর।
বাংলা একাডেমি বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ১৯৬৬ সালে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। প্রস্তাবগুলি ছিল, বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিন। বাকী মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন হতে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিন। প্রতি চতুর্থ বছরে ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত ১টি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিন। এই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে বাঙালির জীবন বাস্তবতা কৃষিভিত্তিক জীবন জীবিকা, আবহাওয়াগত উপলব্ধিসহ সবকিছুর মমতামাখা বিবেচনা রয়েছে। এমন বৈচিত্রময় বর্ষপুঞ্জি অন্য কোনো সংস্কৃতিতে বিরল।
পহেলা বৈশাখে গ্রাম-গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। যদিও শহরে এই মেলার প্রসার বাড়ছে, গ্রামে কমছে। গ্রামীণ সংস্কৃতির ব্যবহার্য ঐতিহ্যবাহী নানা উপকরণের পসরা সাজানো হচ্ছে শহরে। থাকছে কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্ত শিল্প দ্রব্য, বিভিন্ন ঘরোয়া সরঞ্জমাদি, হাতি, ঘোড়া, খেলনা, খাজা, গজা, চিড়া, খই, সাচ, মিষ্টি, কুলা, ডালা, পাখা ইত্যাদির পরসা। এছাড়াও আগের দিনে গ্রামে প্রদর্শনী হতো ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, সাপ খেলা, বায়স্কোপ দেখা, পুতুল নাচ, বলী খেলা, লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ, যাত্রা, জারী গান মাস জুড়ে দিন ভর। এখন গ্রাম ছাড়িয়ে শহুরে মানুষের আনন্দের উপকরণ হতে শহরগুলোতে মেলার আয়োজন করা হয়।
ঢাকা শহরের চারুকলা থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয় তা সারা বিশ্বে এক আনন্দময় ঐতিহাসিক ঘটনা। রমনা পার্ক ছাড়িয়ে আশপাশ অঞ্চল জুড়ে এক আনন্দ মিছিল। হাজার হাজার লোকে লোকারণ্য। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে হাজারো কন্ঠে বর্ষবরণ। রবীন্দ্র সরোবর, জাতীয় সংসদ অঞ্চল, চন্দ্রিমা উদ্যান মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য বিনিময়ের এক অনন্য সময়। সেই সাথে বাড়িতে বাড়িতে নববর্ষের আনন্দ আয়োজন। সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষ বাঙালির পান্তা-ইলিশের, ভর্তা ভাতে আবদ্ধ নয়, এ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, একটি বছরের আনন্দময় শুভ সূচনা। এই সূচনার সঙ্গে রয়েছে প্রাণের গভীর যোগ। রয়েছে বুক ভরে নিজস্ব জাতিসত্তার নিঃশ্বাস নেবার তাগিদ। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)