আমরা যে সময় বেড়ে ওঠেছি, তখন বিনোদন বলতে ছিল বেতার, ফুটবল আর সিনেমা। বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে তো আর কোথাও যেতে হতো না। মাঠে না গিয়েও টের পাওয়া যেত ফুটবল খেলার স্পন্দন। কিন্তু সিনেমা তো ঘরে বসে দেখার সুযোগ ছিল না। পারিবারিক বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা দেখা। সেজে-গুজে সবাই একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়াটা ছিল একটা উৎসবের মতো।
সেই সময়ে যে সিনেমাগুলো দেখার সুযোগ মিলতো, অবধারিতভাবে নায়ক থাকতেন এক ও অদ্বিতীয় রাজ্জাক। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন রাজাধিরাজ। কেন যেন মনে হতো, নায়ক হলে বুঝি এমনই হতে হয়। তখনকার প্রজন্ম তাঁর মতো নিজেকে কল্পনা করতেন। আর কিছু না হলেও তাঁর মতো রোমান্টিক হতে চাইতেন।
এ কারণেই বোধহয় সে সময় কারও মধ্যে প্রেমিক প্রেমিক ভাব দেখা গেলে বলা হতো, রাজ্জাক রাজ্জাক ভাব, কবরীর অভাব। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি শুধু সবার মনই জয় করেন নি, তাঁর হাসি, তাঁর স্টাইল, তাঁর ভঙ্গিমা অনুকরণ করার হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষ করে, তাঁর চুলের স্টাইল খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাঁর মতো আর কোনো অভিনেতা এত দীর্ঘ সময় জনমানসে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন নি।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর মতো জনপ্রিয় অভিনেতা আর কেউ ছিলেন না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজ্জাক অভিনীত ছবিগুলো মাত করে দেয়। সেই ছবিগুলোর গানগুলো বেতারের সুবাদে সবার হৃদয়ে স্থান করে নেয়। গানগুলোর আবেদন আজও ফুরিয়ে যায় নি। স্বাধীনতার পর প্রথম সুপারহিট হয় তাঁর অভিনীত ‘রংবাজ’।
এই নামকরণের মধ্যে একটা চমক ছিল। প্রকৃতঅর্থে তিনি যেন হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ‘রংবাজ’। এই ছবির গান ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না’, ‘হৈ হৈ হৈ রঙিলা’ ছিল সবার মুখে মুখে। এরপর ‘আলোর মিছিল’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ইত্যাদি ছবিগুলো দারুণভাবে সাড়া জাগায়।
বেশি তোলপাড় সৃষ্টি করে ‘অনন্ত প্রেম’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম চুম্বনের দৃশ্যের পাশাপাশি বিয়োগান্ত প্রেম ছিল প্রচলিত ধারার বাইরে। এ কারণে আলোচনার ব্যাপক খোরাক যোগায়। তবে সেই বয়সে মন খারাপ করে দিয়েছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’।
বাথরুমে আটকা পড়া একজন স্কুল ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়েছিল। যে কারণেই হোক, রাজ্জাকের অভিনয় ছুঁয়ে যেত হৃদয়। প্রায় প্রতিটিতে ছবিতে তিনি আলাদাভাবে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতেন। আসলেই তিনি আমাদের সময়ে ছিলেন বিনোদন জগতের বাদশাহ।
যদিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন আর বিনোদিত করতে পারে না। কিন্তু তারপরও নায়ক রাজ রাজ্জাক নামটি উচ্চারিত হলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর টুকরো টুকরো দৃশ্যপট। যা এখনও এনে দেয় সুখের অনুভূতি। তিনি চলে গেলেও থেকে যাবেন আমাদের অন্তরে। আমাদের হৃদয়ে। আমাদের ভালোবাসায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)