চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কি ধ্বংস হয়ে যাবে?

বেশ কিছুদিন ধরেই ভীষণরকম অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। প্রতিদিন শত শত রোগী আর স্বজনদের ভীড়ে যে হাসপাতালটি কর্মমুখর থাকতো সেই হাসপাতালে এখন কেবলই নিরবতা। জরুরি ভিত্তিতে কিছু কাজকর্ম চললেও সবই যেনো স্থবির হয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ, ব্যক্তি বিশেষের শক্তি প্রদর্শন, শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামানো, শিক্ষকদের হুমকি প্রদর্শন, ফেসবুকে মিথ্যাচার, হাসপাতালটি যাদের হাতে গড়া তাদের উত্তরাধিকারদেরকে সুকৌশলে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র– এসবই হাসপাতালটির চলার পথে তৈরি করেছে নানা জটিলতা। আর এই জটিলতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ রোগী ও শিক্ষার্থীরা। সবমিলিয়ে হাসপাতালটিতে এখন ধ্বংসের হাতছানি।

আশির দশকের মধ্যভাগে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। কিছু স্বপ্নচারী দেশপ্রেমিক চিকিৎসক সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিতে একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেসময় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ বলতে দেশের সরকারি হাসপাতাল ও কলেজগুলোকেই বুঝাতো যেখানে সবসময়ই সর্বশ্রেণীর রোগীতে ঠাসা থাকতো। তাই বড় সংখ্যক সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা পাওয়াটা ছিল দূরহ ব্যাপার। একই সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা এবং স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে জটিল রোগীদের বড় অংশই সুচিকিৎসা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো।

এ ধরনের সমস্যা মেটাতে এবং মোকাবিলা করার অভিপ্রায় নিয়েই বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয় বেসরকারি বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে সেটাকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হিসেবে অনুমোদন লাভ করে।

গত তিন দশকে দেশের চিকিৎসা জগতে পরিপূর্ণ হাসপাতাল হিসেবে স্বল্পমূল্যে সেবা এবং নতুন নতুন চিকিৎসার প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ বিশেষ অবস্থান তৈরি করে। তুলনামূলক কম খরচ হওয়া এবং সরকারি মেডিকেল কলেজের মতো জটিলতা না থাকার কারণে স্থানীয় চারপাশের মানুষসহ সারাদেশের মানুষের কাছেই বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আস্থা লাভ করে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হিসেবেও নিজেদের অবস্থানকে অনেক উঁচুতে নিতে সক্ষম হয়।

এখনও সরকারি কলেজের বাইরে প্রাইভেট মেডিকেলে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ সবার শীর্ষে। ঢাকার বাইরে সরকারি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীকেও দেখা গেছে সরকারি কলেজ ছেড়ে বাংলাদেশ মেডিকেলে এসে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করতে। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সব অর্জন ও গর্ব যেন ম্লান হয়ে গেছে। একের পর এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধর্মঘট, কর্মবিরতি, মিছিল মিটিং এর কারণে হাসপাতালে সেই প্রাণস্পদন আর নেই। অনেকটাই যেনো মৃত এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেলে এখন যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে এর মূল উৎস হলো: হাসপাতালটি কারা পরিচালনা করবে এই বিষয়টির উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং বিষয়টি মীমাংসিত না হওয়া। মূল জটিলতা এখানেই। মূলধারার পক্ষ বলছে, হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিস এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট (বিএমএসআরআই) এর সদস্যদের উপর যেটা প্যারেন্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে পরিচিত। শুরু থেকে এভাবেই এই প্যারেন্ট অর্গানাইজেশনের আওতায় সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে। সব ধরণের নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন, সুযোগ-সুবিধা এসব কার্যসম্পাদন করার এখতিয়ার বিএমএসআরআই এর, অন্য কারো নয়। গভর্নিং বডি শুধু একাডেমিক বিষয়টি দেখবে।

অন্যদিকে বর্তমানে গর্ভনিং বডির কতিপয় সদস্য দাবি করছে, বিএমএসআরআই-এর কতিপয় ট্রাস্টির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সুতরাং হাসপাতাল পরিচালনার এখতিয়ার তাদের নেই। হাসপাতাল গভর্নিং বডির নির্দেশেই চলবে।

বাংলাদেশ মেডিকেলের বর্তমান যে অবস্থা তার জন্য গভর্নিং বডির নেতৃত্বে থাকা এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অনেকেই আঙুল তুলেছেন। ওই অধ্যাপক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বলয়ের মানুষ। অনেকের মতে তার নেতিবাচক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে বর্তমান অবস্থা। দীর্ঘ ৬ বছর হাসপাতাল পরিচালনায় থাকলেও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা, চেইন অব কমান্ড, পরিবেশ, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং, মনিটরিং, হাসপাতালের আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি খুব ভালো ভূমিকা রাখতে পারেননি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেসরসারি ক্ষেত্রে দেশে চিকিৎসা শিক্ষা, সেবা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য, দেশবরেণ্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ (অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জনাব মাহবুবুজ্জামান, অধ্যাপক আবু আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক সি এইচ কবির, অধ্যাপক কামরুদ্দিন, অধ্যাপক এম আই চৌধুরী, অধ্যাপক শামসুল হক, বারেক চৌধুরী, সিরাজুল হক) নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিষ্ট্রিত বি এম এস আর আই (বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিস এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট) নামে একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নয় জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে আজ আর কেউ বেঁচে নেই। এই প্রতিষ্ঠানের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যেটি দেশে বেসরকারি পর্যায়ের সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

বি এম এস আর আই পরবর্তীতে চিকিৎসা সেবার প্রসারের জন্য একে একে বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তোলে। এই সবকটি প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষা ও সেবার মানের জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপরিচিত। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশ ও  বিদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রীসহ প্রায় ১২,০০ এর অধিক ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস সহ প্রায় ৪,০০০ (চার হাজার) কর্মকর্তা ও কর্মচারী বর্তমানে কর্মরত আছেন।

বিএমএসআরআই এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত। সরকারের নিময়নীতি মোতাবেক এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ ও উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি পৃথক গভর্নিং বডি রয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে দীর্ঘদিন যাবত গভর্নিং বডির চেযারম্যান হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন বিএমএসআরআই এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ ইউসুফ আলী । তার তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় দিন দিন প্রতিষ্ঠানটি দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করে। এর আগে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন অধ্যাপক এম আই চৌধুরী, অধ্যাপক আফতাব, অধ্যাপক জেনারেল আনিস ওয়াইজ ও অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান।

২০১১ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত আছেন অধ্যাপক তইমুর নেওয়াজ। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত আছেন স্বনামধন্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান। তবে গভর্নিং বডির অনেকেই বর্তমান অবস্থায় খুব ভাল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেলে এখন যে অবস্থা চলমান রয়েছে তার একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন। এর জন্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট দক্ষ নির্লোভ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষের সেবার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটিকে কোনোভাবে ধ্বংসের দিকে নেওয়া যাবে না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ কলেজটির সবার মাঝেই এক ধরণের হতাশা তৈরি হয়েছে। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে গেলে প্রথমেই সবার ঐকমত্য প্রয়োজন। একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ, মান অপমান করে, হুমকি দিয়ে, ধর্মঘট করে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে দুদক অবশ্যই তাদের নীতি কাঠামোর মধ্যে থেকে তদন্ত করবে। তবে সবার আগে প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানো এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো প্রয়োজন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)