চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলাদেশ বেতারে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা

১৯৭৫।ভোর রাত সাড়ে চারটার দিকে শাহবাগের বাংলাদেশ বেতার অফিসের বাইরে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। রাত ২ টায় বেতারের সেদিনকার অনুষ্ঠান শেষ করে রাতের সেশনে উপস্থিত ছিলেন বেতার প্রকৌশলী শিফট ইনচার্জ প্রণব চন্দ্র রায়, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী। কিছু সময় পর সামরিক বাহিনীর লোকেরা বেতার অফিসে প্রবেশ করে। ঢুকেই তারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র করে।
এরপর সেনারা বেতারের কন্ট্রোলরুমে প্রবেশ করে। সেনাদের একজন নিজেকে মেজর ডালিম বলে পরিচয় দেয় এবং বেতারের দায়িত্বে কে উপস্থিত আছে জানতে চায়। সেনারা সকলে অস্ত্র উঁচিয়ে রেখেছিল।
প্রণব চন্দ্র রায় নিজের পরিচয় দেয়ার পর ডালিম তাকে বলে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। বেতার চালু করা হোক, তারা এই খবর প্রচার করবে।
অস্ত্রের মুখে বেতারকর্মীরা বেতার চালু করে দিলেন। ডালিম তখন বলে, যদি আমার বক্তব্য প্রচারিত না হয়, শোনা না যায়, তবে তোমারা সবাই মরবে। প্রণব ডালিমকে বলেন, কল্যাণপুর স্টেশনের ট্রান্সমিটার বন্ধ করা থাকলে বক্তব্য প্রচার হবে না।
ডালিম প্রণবকে কল্যাণপুরে যোগাযোগ করে ট্রান্সমিটার চালু করার আদেশ দেয়। প্রণব কল্যাণপুর স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মতিনকে ফোন করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও বেতার স্টেশনে ডালিমের উপস্থিত থাকার কথা জানিয়ে ট্রান্সমিটার চালু করার জন্য বলেন। আবদুল মতিন বিষয়টি ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি। তাই প্রণবের সাথে এনিয়ে আরো কথা বলতে থাকলে, ডালিম প্রণবের কাছ থেকে ফোনটি কেড়ে নিয়ে মতিনকে গালাগালি করে। মতিন দ্রুত ট্রান্সমিটার চালু করে দেন।বঙ্গবন্ধুর খুনীরা
কিছুক্ষণ পর বেতারে খুনি ডালিমের কন্ঠস্বর ভেসে আসে- “অামি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আর্মি ক্ষমতা দখল করেছে। অনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে।”
বিরতি দিয়ে দিয়ে বেতারে ডালিমের এই বক্তব্য প্রচার হতে থাকে।
ডালিমের বেতারে দেয়া বক্তব্যে আরো বলা হয়- “বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাই-বোনেরা, আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরমদণ্ড দেয়া হইবে। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
সকাল সাতটার দিকে খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর বেতার ভবনে আসে। তাহের উদ্দীন ঠাকুর মুশতাকের জন্য একটি বক্তব্য লিখছিল। ঘণ্টাখানেক পরে সকাল ৮ টায় মুশতাকের বক্তব্যটি রেকর্ড করা হয়।
বক্তব্যে মুশতাক বলেছিল- “আসসালামুআলাইকুম। প্রিয় দেশবাসী, এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আজ দেশ ও দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও দেশবাসীর উপর নির্ভর করে দেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নয়া সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। দেশের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী এই পদক্ষেপের সাফল্যের জন্য বীরের মতন এগিয়ে এসেছেন। দেশের সামরিক, আধাসামরিক, পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী প্রভৃতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে অবিলম্বে সুশৃঙ্খলভাবে নয়া সরকারের নির্দেশে ঐক্যবধ্য হবার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। দেশবাসী ভাই-বোনদের পরম সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে এই পদক্ষেপকে সংহত এবং বাংলাদেশকে সত্যিকারের সুখীসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিণত করার জন্য অবিচল দৃঢ়তা নিয়ে আমার সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বশান্তি ও প্রগতিতে বিশ্বাসী সকল দেশকে এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
মুশতাকের এই বক্তব্যের সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত ছিল, রক্তাক্ত যুদ্ধ ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে সরে এসে অভিশপ্ত পাকিস্তানের পথে হাঁটা শুরু করছে।
প্রণব জবানবন্দীতে বলেন, সকাল ৯ টার দিকে মোশতাকের সাথে দেখা করতে সেনা প্রধান শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার, নৌপ্রধান এম এইচ খান, বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নুরুল ইসলাম দেখা করতে আসে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর তাদের জন্য বক্তব্য লিখে দেয় এবং তাদের বক্তব্য রের্কড করে বেতারে প্রচার করা হয়।
তাদের সেই বক্তব্যে বলা হয়- “দেশের নতুন সরকারের প্রতি আমরা আমাদের অবিচল আস্থা ও আনুগত্য জ্ঞাপন করছি। আমাদের সকল পর্যায়ের অফিসার ও জওয়ানদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ কমান্ডারদের নির্দেশ অনুযায়ী স্ব স্ব দায়িত্বে নিযুক্ত থাকার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।”
প্রণব আরো জানান, মোশতাকের সাথে দেখা করতে জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফ বেতারভবনে এসেছিল।
বেতারে বারবার ভেসে আসছিল- মুজিব মৃত, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে বাংলাদেশেরও আর্দশিক মৃত্যু হয়েছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)