বাংলাদেশের জনগণ এখন ২০ বছর আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি মাছ খায়। কিন্তু সেই তুলনায় মাছ থেকে পুষ্টি কম পাচ্ছে তারা। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মাছ পৃথিবীর সর্বত্রই অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেই মাছ খাওয়ার পরিমাণ বাড়ার পরও মাছ থেকে পাওয়া পুষ্টির পরিমাণ কেন কমছে, তার কারণ হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতির বেশকিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে চলতি মাসে প্রকাশিত গবেষণাটিতে।
বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং মালয়েশিয়ার গবেষকদের পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের মানুষ এখন কী ধরণের মাছ বেশি খেতে পাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য বেশিরভাগ অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ও বড় হওয়া মাছ ধরার পরিমাণ কমে যাচ্ছে সময়ের সাথে। এখন মূলত মাছ বলতে মানুষ চাষ করা মাছই বেশি পায়। সব মাছ চাষ করা হয় না বা সম্ভব হয় না বলে ঘুরেফিরে বিশেষ কিছু প্রজাতির মাছ খাওয়া পড়ে বেশি।
এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাছ শিকার, পানিদূষণ এবং পরিবেশের ক্ষতির কারণে মাছের সংখ্যা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাপ্তিও কমে গেছে। যার ফলে ১৯৯১ থেকে ২০১০ সময়টাতে চাষবিহীন প্রাকৃতিক মাছ খাওয়ার পরিমাণ নেমে গেছে ৩৩ শতাংশ।
বিশ্বজুড়েই কমবেশি এই অবস্থা প্রকৃতিতে পাওয়া মাছের। কিন্তু যত কমছে প্রকৃতিতে পাওয়া মাছ, তত বাড়ছে মাছ চাষের প্রবণতা। মাছ চাষ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান খাদ্য উৎপাদন সেক্টর, যার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। বাংলাদেশেও ১৯৮০’র দশকে মাছ চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সেক্টরটি। বর্তমানে চাষকৃত মৎস্যপণ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ষষ্ঠ।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, চাষকৃত মাছের তুলনায় প্রকৃতিতে পাওয়া মাছের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রকৃতি থেকে শিকার করা মাছের মধ্যে রয়েছে তিনশ’র বেশি স্থানীয় ছোট মাছের প্রজাতি। এগুলোর বেশিরভাগই মাথা এবং কাঁটাসহই একবারে খাওয়া হয়। এই ছোট মাছগুলো হচ্ছে পুষ্টির ‘পাওয়ারহাউজ’, যার মধ্যে আছে আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ‘এ’র মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসহ উচ্চমানের প্রোটিনের মতো অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এই মাছগুলোই আগে খাওয়া হতো বেশি।
অন্যদিকে সাধারণত চাষ করা হয় হাতেগোনা কিছু দেশি-বিদেশি প্রজাতির বড় মাছ। এগুলোর মূলত মাংসটুকুই খাওয়া হয়, যাতে উচ্চমানের প্রোটিন থাকলেও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে অনেক কম।
চাষের মাছ তুলনামূলক সহজলভ্য হওয়ায় তা বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে চলে এসেছে বেশি। আর এ কারণেই মাছ খাওয়ার পরিমাণ বাড়লেও পুষ্টির পরিমাণ বাড়েনি, বরং আরও কমেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় পরিচালিত এই গবেষণায় পাওয়া তথ্য সমর্থন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফজলুল আউয়াল মোল্লা বলেছেন, ‘আগে আমরা ছোট মাছ বেশি খেতাম এবং সেটা খেতাম কাঁটা এবং মাথাসহ। আমরা এ-ও জানি মলামাছের মতো মাছগুলোর চোখ খেলে রাতকানা রোগ হয় না। এখন আমরা চাষ করা বড় মাছ খাই বেশি। এদিক থেকে গবেষণাটির কথা সত্যি – মাছ খাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু পুষ্টি বাড়ছে না, বিশেষ করে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস।’
দূষণসহ নানা কারণে পুষ্টিকর বেশ কিছু দেশি মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আরও কিছু বিলুপ্তির পথে – জানান এই অধ্যাপক। বলেন, অপরিকল্পিত মাছশিকারের কারণে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশি মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এজন্যও খাদ্যতালিকায় এসব মাছ কমে যাচ্ছে।
এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রথমে প্রাকৃতিক মাছ ও জলাশয় সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন ড. ফজলুল আউয়াল। নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো দূষণমুক্ত রাখা, মৎস্য বিষয়ক আইনগুলোর কঠোর ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরিকল্পিত মৎস্যনিধন এবং প্রজনন মৌসুমে মাছশিকার বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে যেন মাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য উপযুক্ত সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে।
ছোট বেশি পুষ্টিকর মাছ চাষ করা যায় কিনা – এ ব্যাপারে অধ্যাপক ফজলুল আউয়াল বলেন, ‘মৎস্যচাষী তো সেই মাছটাই চাষ করবে, যেটাতে তার লাভ বেশি হবে। ছোট মাছ চাষে লাভ কম। তাই তাদেরকে বললেও তারা ছোট মাছ চাষ আগ্রহী হবেন না। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাকৃতিক উৎস সংরক্ষণের দিকেই আগে নজর দিতে হবে।’