বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা ও কাজের সুযোগ বাড়ার দিক থেকে গণমাধ্যম স্বাধীন হলেও পেশাদারিত্বের অভাব, কর্পোরেট চাপ, অপরাধ সংগঠনকারী বিভিন্ন গ্রুপের হুমকি, সহিষ্ণুতার অভাব এবং স্বাধীন মত মেনে নেয়ার মানসিকতা না থাকাসহ নানা কারণে দেশের গণমাধ্যম পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না বলে দেশের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এছাড়া রাজনৈতিক পর্যায়ে ধরনের সহনশীলতার অভাব ও বিভিন্ন গণমাধ্যম হাউজের প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে কিছু না থাকায় এ মুহুর্তে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আসলে কতটা মুক্তভাবে সাংবাদিকতা করতে পারছে? বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মোঃ মফিজুর রহমান, টিভি অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজের সাবেক চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভুঁইয়া এবং বেসরকারি একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সরকারের দিক থেকে গণমাধ্যমের ওপর তেমন কোন সেন্সরশিপ নেই। সে অর্থে গণমাধ্যমকে স্বাধীনই বলা যায়। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজি, মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।
পেশাদারিত্বের অভাবকে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সাংবাদিকতায় দক্ষতার অভাব রয়েছে। টিভি, রেডিও, পত্রিকা, অনলাইন পোর্টালসহ এত এত গণমাধ্যম কিন্তু সেখানে যোগ্য লোকের সংখ্যা খুবই কম। এটাও মুক্তভাবে সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা।
এক সময় রাষ্ট্রকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় মনে করা হলেও বর্তমানে সামাজিক অপশক্তিগুলোই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মফিজুর রহমান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, এক সময় মনে করা হতো সরকারই হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বর্তমানে আর তা মনে করা হচ্ছে না। কারণ সামাজিক অপশক্তিগুলো এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, জঙ্গিবাদ বর্তমানে প্রধান সামাজিক অপশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার ফলে অনেক গণমাধ্যমই সেল্ফ সেন্সরড হয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে।
তাছড়া অপরাপর অপশক্তিগুলোও সাংবাদিকদের সব সময় চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ব্যাহত হয়। এছাড়া মুক্তভাবে সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্রে মালিক পক্ষ এবং বিজ্ঞাপণদাতাদের চাপকেও অন্যতম বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল আলম ভুঁইয়া।
টিভি অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি মনে করি আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুল এখন বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন: ১/১১ এর পট পরিবর্তনের সময় গণমাধ্যমগুলো অনেক কিছুই বলতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তা পারছে। তবে মালিক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপে সাংবাদিকরা চাইলেও অনেক কিছু লিখতে বা বলতে পারছে না। যা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সমালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয় বলার স্বাধীনতা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকতার দিক থেকে সে স্বাধীনতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বেসরকারি একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো স্বাধীন। কারণ এখানে নানা ধরনের সমালোচনাসহ অনেক কিছু বলা যাচ্ছে। কিন্তু যে জায়গায় এসে এ স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাচ্ছে তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকতা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখনও সংগঠন পর্যায়ে আছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যেতে পারেনি। ‘বেশিরভাগ (গণমাধ্যম) হাউজেরই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। কোন একজন লোক একটি লাইসেন্স পেল। তিনি একটি হাউজ ওপেন করে দিলেন। কিছু লোক নিয়োগ করা হলো। কিন্তু তাদের ব্যাপারে যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা ভাবনা করা বা শৃঙ্খলার সাথে কিছু ভাবা সেটা নেই। ফলে এখানে বেতন ভাতায় অনিয়ম আছে। এখানে চাকরির নিশ্চয়তা অনেক কম। এখানে ঝুঁকি অনেক বেশি। কোন সংবাদকর্মী যদি কোনভাবে বড় ধরণের কোন ঝুঁকির মোকাবেলা করে সেখানে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে কোন সহযোগিতা করা হয় না।’
রাজনৈতিক পর্যায়ে এক ধরনের সহনশীলতার অভাবের কথা উল্লেখ করে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ভয়ঙ্করভাবে অসহিষ্ণু। তারা কেবল ভাবে তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে। বিপক্ষে গেলেই তারা সাংবাদিকদের প্রতি মারমুখী আচরণ করে। এসব ভাবলে বলা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আসলে সেই অর্থে স্বাধীন নয়।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যতটুকু রয়েছে তা মূলত মালিকদের, এখানে সাংবাদিকদের কোন স্বাধীনতা নেই। মালিকদের পছন্দই বড় পছন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন তাদের মত করেই সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা করতে হয়।
রাজনৈতিক বিবেচনায় সাংবাদিকদের বিভক্তিকেই এ অবস্থার জন্য দায়ী করে এ সাংবাদিক বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বিভক্তির ফলে সাংবাদিকদের কোন অধিকার যেমন রক্ষা হচ্ছে না, তেমনি পেশাদারিত্বের জায়গায় দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকট।
প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে কিছু না থাকায় এ মুহুর্তে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন একাত্তর টিভির এ বার্তা পরিচালক।