টান টান উত্তেজনার মধ্যে এবার আমরা পহেলা বৈশাখ পালন করতে যাচ্ছি। উত্তেজনার শুরুটা ছিল সীতাকুণ্ড, সিলেট, মৌলভীবাজার, কুমিল্লায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান ও সেখানে পরিচালিত অভিযান, পাল্টা হামলা এবং আত্মঘাতী তৎপরতায় হতাহতের মধ্য দিয়ে।
জঙ্গি ইস্যু চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের শ্রীলংকা সফরে গেলে। সেখানে আকস্মিক মাশরাফির অবসর গ্রহণের ঘোষণা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ইতিবাচক কিছু না হওয়ার ঘটনা ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের অর্জন-বিসর্জন নিয়ে যখন মিডিয়া মত্ত, তখন হঠাৎ করে প্রায় এক বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস এক টিভি চ্যানেলে দাবি করেন যে, তার সন্তানের বাবা হচ্ছেন নায়ক শাকিব খান! কিন্তু শাকিব খান তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিচ্ছেন না! ব্যস্, অন্য সব খবর-ঘটনা ছাপিয়ে দেশবাসী মেতে উঠে শাকিব-অপু কেচ্ছা নিয়ে।
এই কেচ্ছা-কাহিনি ঢেকে দেয় অন্য সব ইস্যু ও প্রসঙ্গ। আবার এই ইস্যুও রাতারাতি চাপা পড়ে যায় মৌলবাদীদের দাবির মুখে হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত এক নারী-মূর্তি সরানোর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও মন্তব্যে। সুশীল-শিক্ষিতরা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য শুনে হতবাক হয়ে যান!
এর আগে মৌলবাদীদের কথা শুনে পাঠ্যপুস্তকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার তাদের আবদার অনুযায়ী হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত মূর্তিটি অপসারণের পক্ষে খোদ প্রধানমন্ত্রেই তার অবস্থান ঘোষণা করেছেন। যারা আধুনিকতা, যুক্তি-বুদ্ধি প্রগতিশীলতার ধার না ধেরে ধর্মের মোড়কে দেশকে পেছনে ঠেলে দিতে চাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী এবার যেন তাদের অনুভূতিরই ধারক-বাহক হয়ে উঠেছেন! মূর্তিবিরোধী এই শ্রেণিটি শুধু মূর্তি অপসারণই নয়, পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিলসহ পহেলা বৈশাখ পালনের বিপক্ষেই তেড়ে-ফুঁড়ে উঠেছেন!
মৌলবাদবিরোধীরা এতে তীব্র রাগ-ক্ষোভ হতাশায় ফেসবুক ভরিয়ে ফেলছেন! এদিকে এই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে বর্ষবরণ উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের দেয়ালে আঁকা চিত্রে পোড়া মবিল ঢেলে দেওয়ার ঘটনা।
এর মধ্যেই দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া শেষে বুধবার রাতে আলোচিত জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান, তার দুই সহযোগী বিপুল ও রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এত সব ঘটনার ডামাডোল ও তীব্র দাবদাহকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এবার বাংলা নববর্ষ পালন করতে যাচ্ছি।
তবে আশার কথা হচ্ছে, মৌলবাদীদের ফতোয়া ও সরকারি বিধিনিষেধ সত্বেও বর্ষবরণের সমারোহে খুব একটা ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। রাজধানীর মার্কেটগুলোতে চলছে সাজ-সাজ রব। পহেলা বৈশাখের বিকিকিনি চলছে পুরো দমে। বিভিন্ন ছোট-বড় সংগঠনের বর্ষবরণের প্রস্তুতিও চলছে মহাসমারোহে!
যথারীতি ইলিশ নিয়ে এবারও তেলেসমাতি কাণ্ড চলছে। ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার পহেলা বৈশাখে ইলিশ খেতে বারণ করেছেন। ডিম ছাড়ার মৌসুম বলে এই সময়ে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ইলিশ কেনার ধুম চলছে। জাটকা ইলিশে ছেয়ে গেছে বাজার। নববর্ষের দিন ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয় বলে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও শহুরে মধ্যবিত্তদের ইলিশ কেনা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না!
বৈশাখে ‘পান্তা-ইলিশ’ আসলে করপোরেটের তৈরি করে দেওয়া সংস্কৃতি, যা নব্বই দশকের শুরুতে আবির্ভাব হয়। এই সংস্কৃতি এখন গ্রামেগঞ্জেও বিস্তৃত হচ্ছে। এটা খুব একটা শুভ লক্ষণ নয়! যে উৎসবটাকে আমরা বলছি বাঙালির ‘প্রাণের উৎসব’, কোনো বিশেষ ধর্মের বাইরে সব মানুষের, সব জাতিগোষ্ঠীর উৎসব-সেটাকে ধর্ম আর নিরাপত্তার অজুহাতে ‘কর্তন’ বা ‘খণ্ডিত’ করার একটা অপপ্রয়াস যেমন আমরা দেখছি, পাশাপাশি দেখছি বর্ষবরণের একটা যুক্তিহীন হুজুগ। আপাতত সেই হুজুগের জয় হোক-আমরা সেটাই চাই। তাতে অন্তত ধর্মব্যবসায়ীদের গালে থাপ্পর পড়বে।ছাই পড়বে লম্পটদের বাড়াভাতে, যারা নারীর চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমাদের অনেকেরই ‘বাঙালি’ হওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ মেলে এই পহেলা বৈশাখে। ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ এ সব দিনেও বাঙালিত্বের অহংকার করা যায় বটে, কিন্তু বৈশাখ মাস সবার উপরে। এক কালে নাকি বৈশাখই ছিল বিয়ের মাস। এখন অবশ্য আর দিনক্ষণ মানে না কেউ।
তবে কিছু আঁতেল আছে যারা এ দিন ‘অন্য রকম বাঙালি’ সাজতে চায়। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সকালে রবীন্দ্রসংগীত শোনে; দুপুরে ইলিশ-ভাত সাঁটিয়ে ভাতঘুম দেয়। সন্ধ্যায় হাই তোলে আর রাত আটটা বাজলেই হুইস্কির বোতল নিয়ে বসে। কাবাব-পরোটার সঙ্গে হুইস্কির নেশা যখন জমে ওঠে, তখন অতীতের জন্য হাহাকার করে ইংরেজিতে কিছু গালাগাল ঝাড়ে!
সে জন্যই বুঝি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধা জননী/রেখেছ বাঙালি ক’রে মানুষ করনি।’ বাঙালিত্বের ধারণা যে আসলে সোনার পাথরবাটি, এ কথা জানতেন তিনি। তাই বোধ হয়, ‘বাঙালি’কে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পরামর্শ। অনেক দিন আগে এক পাহাড়ি মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমরা বাঙালিরা কেউ গোরা (ফর্সা), কেউ কালা হও কেন? আমাদের তো এমন হয় না।’ সত্যিই তো, আমরা যে শংকর, সেটাই তো ভুলে গেছি আমরা। আমরা, স্বার্থপর, অলস, তার্কিক, কর্মবিমুখ, ভীরু, বাক্সর্বস্ব, আত্মঘাতী, পরনিন্দুক, রাজনৈতিক কোলাহলপ্রিয় বাঙালিরা!
বঙ্কিমচন্দ্র নির্মম ঠাট্টা করেছিলেন বাবু-বাঙালিদের নিয়ে, ‘…যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহার কালে আপন অঙুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথন কালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু… যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান এবং বেশ্যাগৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু!’ ‘বাবু বাঙালি’র সেই কালচার আমাদের সমাজে এখনও অনেকের মধ্যেই রয়ে গেছে!
তবে এক দিনের জন্য বাঙালি সেজে কোনো লাভ নেই। আর খাঁটি বাঙালি বলেও কিছু নেই। খাঁটি বাঙালিত্বে অনেক জল, অনেক ভেজাল। আমাদের রক্ত থেকে ভাষা পর্যন্ত সবই শংকর। বাঙালি যে গুণ আয়ত্ত করেছে, তা হল আগ্রাসী গ্রহণশীলতা। একে লুণ্ঠনবৃত্তি বলুন আর চৌর্যবৃত্তিই বলুন, এ জন্যই আমরা অনেকের চেয়ে দু’পা এগিয়ে। সুনীতিকুমার একে বলতেন ‘বৈতসীবৃত্তি’। আর প্রমথ চৌধুরী মজা করে বলেছিলেন, ‘পরের ধনে পোদ্দারি’। এই শক্তিতেই যে কোনও জাতি-ধর্মের উৎসব, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, লোকাচার অনায়াসে গ্রাস করে নিই আমরা। এ বাঙালি কোনও দিন মরবে না, কেবল বদলাবে।
কেননা, অতি দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলতে পারা বাঙালির এক অসাধারণ কৃতিত্ব (তাইতো মৌলবাদী ভাবধারাপুষ্ট হেফাজতিরা সহজেই মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাওয়ালাদের সমর্থন পেয়ে যায়)! বাড়ি বদল, চাকরি বদল, বউ বদল, দল বদল, আনুগত্য বদল, রং বদল— পোশাক বদলের মতোই এগুলি বাঙালির কাছে নৈমিত্তিক। গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বা খাপ-খাওয়ানোর ব্যাপারে আমাদের সংস্কৃতিও ভীষণ ওস্তাদ।
বাঙালি সংস্কৃতি সবসময় চলমান। গ্রহণ-বর্জনে ক্ষান্তি নেই তার। এই গ্রহণ-বর্জনের নমনীয়তার কারণেই পিছিয়ে নেই পয়লা বৈশাখ। ইন্টারনেট থেকে পঞ্জিকা, পান্তা-ইলিশ থেকে পিৎজা, পাঞ্জাবি, শাড়ি, জিন্স, লেহেঙ্গা সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। সেসব নিয়েই বাঙালির নতুন বর্ষবরণ।
কেবল বেদনা একটাই, পরিবর্তন-প্রিয় বাঙালির কাছে এ কেবল কুয়োর এ দিক থেকে ও দিকে যাওয়ার চেষ্টা। কুয়োর বাইরে আসার পথ খোঁজা নয়! তারপরও আমরা বাংলা নববর্ষে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব! সবাই মিলে আনন্দে মাতোয়ারা হব! আমাদের বর্ষবরণের সম্মিলিত হুজুগে সব নিয়ন্ত্রণের শেকল, নিষেধাজ্ঞা, মৌলবাদীদের সব ফতোয়া ভেসে যাক, মুছে যাক!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)