চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চরবাসীর দিকে বেশি নজর দিন

দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা এখনও চলমান। কোথাও কোথাও বন্যার পানি কমে আসার সুসংবাদ এলেও অনেক জায়গাতে নতুন করে বন্যা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছেন। তবে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাগট, দুধকুমার, আত্রাই, পুণর্ভবা প্রভৃতি নদীর পানি ক্রমশই কমে আসছে। পানি কমতে শুরু করেছে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীতেও। তবে সেই মাত্রায় পদ্মা, যমুনা দিয়ে পানির গতিবেগ বেশ বেড়ে চলেছে। আরো কয়েকদিন মধ্যাঞ্চল দিয়ে পানি তীব্রবেগে প্রবাহিত হবে এবং বড় ধরনের বৃষ্টিপাত না থাকলে আস্তে আস্তে পানিপ্রবাহ কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন।

কয়েকদিন আগে প্রথম বন্যা কবলিত হয় দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুরসহ উত্তরের কমবেশি সব জেলারই বেশ বড় অংশ বন্যা কবলিত হয়। চরাঞ্চলসহ বন্যা বেশি বিস্তৃত হয় বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে। ফলে দিনাজপুরসহ বেশ কয়েকটি শহরেও পানি ঢুকে পড়ে। মূলত টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণেই বন্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ব্রক্ষ্মপুত্র, গঙ্গা এবং তিস্তা অববাহিকায় পানির উচ্চতা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার ফলে ওই পানি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করার ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। সরকারি হিসাব মতে, মোট ২৬টি জেলার বিভিন্ন অংশ বন্যা কবলিত হয়েছে এবং বন্যায় প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

দ্বিতীয় দফা বন্যায় এবারও বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে চরের মানুষগুলো। বিশেষ করে যারা দ্বীপচরের (অন্তত তিনভাগ পানিবেষ্টিত চর) বাসিন্দা তারা অনেকেই নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছে। কেননা বন্যা শুরু হওয়ার পর প্রথম আক্রান্ত হয় দ্বীপচরগুলো। নদীতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে নদীভাঙ্গনের কারণে দ্রুত ঘরবাড়ি মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায়। আনেক জায়গাতেই এবারও দ্বীপচরগুলো সম্পূর্ণরুপে পানির নিচে চলে এবং চরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। তিস্তার চর গোবর্ধন, বালাপড়া, ডাওয়াবড়ি, চর সির্ন্ধুনা, পাটিকাপাড়া, ভোটমারি এবারও রেহাই পায়নি। ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। এসব চরের কয়েকহাজার মানুষ নিঃস্ব রিক্ত হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষেরই ঘরবাড়ি বলে কিছু নেই। একইভাবে কুড়িগ্রামের ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার নদী বক্ষের অনেক চর রাতারাতি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্ণিবাড়ি, কাজলা, চর চালুয়াবাড়িসহ বহু চরের মানুষ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সিরাজগঞ্জ এবং জামালপুর জেলারও প্রচুর দ্বীপচর এবারের বন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পাবনা জেলার মধ্যচর, জোতকুড়িয়া, বলরামপুর, চর নাগদা, গংরাজানি প্রভৃতি চর তীব্র নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। এসব চরের কয়েক হাজার মানুষের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

দ্বীপচরগুলো মূলত নদীর মাঝখানে অবস্থিত। এসবের চরের সাথে মূল ভূমির কোনা যোগসূত্র নেই। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রক্ষ্মপুত্রসহ আরো কয়েকটি নদীতে এমনই অনেক দুর্গম এবং দূরবর্তী চর রয়েছে যেখানে যেতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগে। দ্বীপচরের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো- বন্যা এবং নদী ভাঙ্গন। আর নদী ভাঙ্গন মানেই চরের দরিদ্র অসহায় মানুষের তিল তিল পরিশ্রমে গড়ে ওঠা সংসার, ঘরবাড়ি, পশুপাখি এবং সহায় সম্বল তছনছ হয়ে যাওয়া। চোখের পলকেই সব নদী গর্ভে চলে যাওয়া। উঠানের চুলো থেকে শুরু করে, গোয়ালঘর, বাড়ির ঘটি বাটি বিছুই থাকে না। অনেকে তড়িঘড়ি কিছু রক্ষা করতে পারলেও অনেকেই আবার পারে না। অর্থাৎ নদীভাঙ্গা পরিবারগুলো এক বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এবারও লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী এবং কালিগঞ্জ উপজেলাতে সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি বন্যার পানি বাড়ার পরপরই বেশিরভাগ দ্বীপচরগুলোকে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে।

বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি বলে অনুমিত। দেশের প্রায় ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অংশবিশেষ চরাঞ্চল। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ মানুষ চরে জীবনব্যাপী বহুবিধ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। চরবাসীর জীবন মানেই অসংখ্য সমস্যায় নিমজ্জিত সংকটময় এক দূরুহ জীবন। চরাঞ্চল উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। চরে বসবাসরত মানুষগুলোর চরম খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস। চরের মানুষের দরিদ্রতার বড় কারণই হলো বন্যা এবং নদী ভাঙ্গন।

বরাবরের মতো এবারও সরকারি ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে বন্যার্তদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। শুরু থেকেই সরকারের দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয় বন্যা আরো তীব্র হলেও সরকারের কাছে যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রী মজুত আছে। কিন্তু শুরু থেকেই কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলো অভিযোগ করে আসছিল তারা খাবারসহ অন্যান্য সহায়তা পাচ্ছেন না। কোনোমতো কিছু শুকনা খাবার খেয়ে বেঁচে আছেন। অনেকে জায়গাতেই বন্যা আক্রান্ত দরিদ্র মানুষগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল এই বলে যে, বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের খোঁজখবর কেউ রাখেনি। কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। এছাড়া বন্যায় দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র অসহায় মানুষ আক্রান্ত হলেও এনজিওগুলোকেও নির্বিকার বসে থাকতে দেখা গেছে। জাতীয় পর্যায়ের কর্পোরেট এনজিওগুলোর অনেকেই ঢাকাতে বিভিন্ন ধরনের উৎসব, কনফারেন্স, সভা-সমাবেশে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেও তাদের তৎপরতা একদমই চোখে পড়েনি। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণের বাণিজ্য করে যেসব এনজিও এখন বিত্তশালীতে পরিণত হয়েছে তারা নিষ্ঠুরভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছে।

প্রায় প্রতিটি জেলাতেই প্রচুর সংখ্যক এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসার সাথে জড়িত। যেসব এলাকা বন্যাকবলিত হযেছে সে সব এলাকাতেও অনেক এনজিও জমজমাট ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকলেও তাদের তৎপরতা খুব একটা চোখে পড়েনি। অথচ একসময় বন্যার্তদের পাশে সবার আগে দাঁড়িয়েছে এনজিওগুলোই। আর এখন বন্যার্ত এলাকায় মানুষের এই চরম দুর্ভোগের সময়ও এনজিওদের কিস্তি তোলা অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় জিও, এনজিও সমন্বয়ের কথা বলা হলেও কেন জানি সেই সমন্বয়টা চোখে পড়ছে না। হাওরের বন্যা, পাহাড় ধসের ঘটনা-সবখানেতেই সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন আপাতত বড় ধরনের বৃষ্টিপাত না হলে বন্যার পানি নেমে যাবে। এটি সত্য যে বন্যার পানি নেমে গেলে চরের মানুষ আবার চরেই ফিরে যাবে। আবার নতুন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তারা জেগে উঠবে। তাদের পাশে কেউ না দাঁড়ালেও তারা আবার বসতি গড়বে, আবার জমিগুলোতে ফসলের চাষ করবে। দেশের দুর্গম চরাঞ্চল যে বরাবরই উন্নয়ন বঞ্চিত এটি নতুন করে বলে অপ্রয়োজন। দুর্গম চরাঞ্চলগুলো আমাদের সবার দৃষ্টিসীমার বাইরের এক অংশ বলেই প্রতীয়মান। ফলে অবহলো, উপেক্ষা, বঞ্চনার মাত্রাও এখানে সবচেয়ে বেশি। চরে বসবাসরত মানুষের বৃহৎ অংশই অতিদরিদ্র বা এক্সট্রিম পুওর। অতিদরিদ্রদের বড় অংশই খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি থেকেই বঞ্চিত। সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ যেসব চাহিদার অনুসৃত রয়েছে তার কোনোটিই পান না চরবাসী। ফলে নিরন্তর দুঃখ-কষ্টের এক বঞ্চনাময় জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। সেই বঞ্চনাময় জীবনকে আরো বেশি কঠিন দুর্ভেদ্য করে তোলে বন্যা।

আমরা লক্ষ্য করছি সরকারের পক্ষ থেকে জোর দাবি করা হচ্ছে প্রচুর ত্রাণ মজুত রয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু শুধু ত্রাণ দেওয়াই শেষ নয়, দুর্গম চরের ঘরবাড়ি হারানো নিঃস্ব মানুষগুলোর উঠে দাঁড়ানোর জন্যে এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা ও সহযোগিতাও দরকার। ঘরবাড়ি তৈরি থেকে তাদের বিভিন্ন ধরনের কৃষি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা পলি পড়া নতুন জমিতে তাদের চেয়ে ভালো চাষবাসের কৌশল আর কেউ জানে না।

চর এবং হাওরের মানুষের উন্নয়নে এবারের অর্থবাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকার বড় অংশই এখন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ দুর্গম চরের মানুষের উন্নয়নে সরকার খরচ করার উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ প্রতিবছরই সরকার চরবাসীর উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ দিলেও সেই টাকা খরচ হয় না। এর আগে পর পর দুই অর্থবছরে ( ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬) সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেই টাকা খরচ হয়নি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ দুর্গম দ্বীপচরবাসীর দিকে অবশ্যই আলাদা নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)