১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মাত্র ৮১ দিনের মধ্যেই তার অবৈধ শাসনামলের অবসান হয়েছিল। ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফসহ পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তখন যে সেনানিবাসে তার অবস্থান কতটা দুর্বল হয়ে গেছে সেটা খালেদ বুঝতে পারেননি। এখন বলাই যায় যে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে বা আটঘাট বেঁধে অভ্যুত্থান করেননি খালেদ মোশারফ। মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরের প্রধান, ঢাকায় গেরিলা ক্র্যাক প্লাটুনের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফের অবস্থানে চিড় ধরেছিল ৪ নভেম্বরেই। এর অন্যতম কারণ ঢাকা সেনানিবাসে তার পক্ষে অনুগত কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য ছিল খুবই কম।
খালেদ মোশাররফের সঙ্গে ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিল এবং তার অধীনের কয়েকজন অফিসার। ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নের পাশাপাশি বিমান বাহিনীর একটি বড় অংশ যারা ২টি মিগ-২১ জঙ্গী বিমান ও দুটি হেলিকপ্টার উড়িয়ে অভ্যুত্থানের শুরুতে বড় ধরনের সমর্থন দিয়েছিল।
এর আগে থেকেই খালেদ মোশাররফ দেশের বিভিন্ন রাজনীতিবিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এদের মধ্যে বামপন্থীরা অনেকেই ছিলেন। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন এ বিষয়ে ডিবিসি নিউজের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘উপসংহার’-এ প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলেছেন। তার যে বই “গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী”-তে তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন: একইসঙ্গে এও সাবাস্ত হলো যে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমর্থন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হবে। ….. রাশেদ খান মেননসহ বাম রাজনীতিবিদদের প্রায় সকলেই তাদের সমর্থনের কথা জানালেন। সর্বহারা পার্টির কর্নেল জিয়াউদ্দিন ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা তার কাছে হস্তান্তরের অনুোরোধ জানিয়ে বললেন, এই সুযোগে আমরা বাংলাদেশের বহকাঙ্খিত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করবো।”
সেপ্টেম্বর মাসেই কর্নেল তাহেরের সাথেও নিজেদের কথা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মেজর নাসির। নিজের বইতে তিনি লিখেছেন, “মেজর হাফিজের বাসায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হলো। তিনি জাসদের অনুসৃত লাইনে তার কথা বলছিলেন। তবে খন্দকার মোশতাকের অপসারণর তার জোরালো সমর্থনও তিনি ব্যক্ত করলেন। অভ্যুত্থানের দিনক্ষণ আগেভাগে জানাবার তাগিদ দিলেন কর্নেল তাহের। এর কারণ তিনি এভাবে দেখালেন যে এই বিশেষ দিনে জাসদের সর্বস্তরের কর্মীরা রাজপথ দখল করে অভ্যুত্থানের অনুকূলে সর্মথন জানাবে।” এসব সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। তখন খালেদ মোশাররফ মেজর নাসিরকে নিয়ে ধানমন্ডিতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসায়ও গিয়েছিলেন। মেজর নাসিরের বইতে লেখা আছে: “মঞ্জুকে তিনি বললেন, তোমার বস মোশতাককে গিয়ে আমার একটি বার্তা পৌঁছে দেবে। বলবে যে তার প্রস্থানের সময় হয়ে এসেছে।” এমন বলা যে ঠিক হয়নি, সেটাও মেজর নাসির বইতে লিখে রেখেছেন।
এসব ঘটনায় বলাই যায় যে খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটানোর আগে থেকে প্রস্ততি নিলেও শেষ পর্যায়ে গিয়ে সব দিক রক্ষা করতে পারেননি। আর জাসদের গণবাহিনী এবং সৈনিক সংস্থাও তখন সক্রিয় ছিল। এ তথ্যও নানাজনের কথায় এবং এ সংক্রান্ত বইতে পাওয়া গেছে যে খালেদ মোশাররফের লোকদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে জেনারেল জিয়াউর রহমান তার লোকেদের দ্বারা কর্নেল তাহেরের কাছে তাকে উদ্ধারের জন্য বার্তা পাঠাতে পেরেছিলেন।
‘উপসংহার’-এর আলোচনায় কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাসদ ৬ নভেম্বর বৈঠক করে যে তাদের ভাষায় সিপাহি জনতার বিপ্লব সংঘটিত করে খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন সেটা বলেছেন জাসদের দুই নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং মঈনুদ্দিন খান বাদলও। আনোয়ার হোসেন বলেছেন, “তাহেরের নির্দেশ ছিলো জিয়াকে সৈনিক সংস্থার যে অংশটা মুক্ত করবে, তারা এলিফ্যান্ট রোডে যেখানে তাহের ছিল সেখানে জিয়াকে নিয়ে আসা হবে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, কর্নেল তাহেরের কাছে। সে অনুযায়ী এলিফ্যান্ট রোডে ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় তাহের ও ইনু অপেক্ষা করতে লাগলেন।” আনোয়ার হোসেন নিজেও সেখানে ছিলেন বলে জানিয়েছেন।
৬ নভেম্বর সারাদিন বঙ্গভবনেই ব্যস্ত ছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম যখন শপথ নিচ্ছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন গৃহবন্দী, তখন কিন্তু সবচেয়ে সক্রিয় জাসদের গণবাহিনী এবং সৈনিক সংস্থা ।
প্রকৃতপক্ষে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন করতে পারলেও নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে খন্দকার মোশতাককে বাধ্য করতে পারলেও, যে বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটি হচ্ছে সেনানিবাসে তিনি কোনো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কর্নেল শাফায়াত জামিলের বই থেকে জানা যায় যে ৬ নভেম্বর বিকেলেই ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ সেনানিবাসে উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়িয়েছে। ওই রাতে আবারো বঙ্গভবন গিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। শাফায়াত জামিলও গিয়েছিলেন আলাদাভাবে। নিজের বইতে শাফায়াত জামিলে লিখেছেন, “রাত ১০টার দিকে খালেদ মোশাররফের ফোন পেলাম। ফোনে তিনি আমাকে বঙ্গভবন যেতে বললেন। গাড়ীতে উঠছি, তখন ব্রিগেড মেজর হাফিজ আমাকে বললো, স্যার একটা জরুরী কথা আছে।” সে সময় মেজর হাফিজ শাফায়াত জামিলকে জানিয়েছিলেন রাতেই সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটি করবে। একজন সুবেদার মেজর মেজর হাফিজকে একথাও বলেছিলেন যে তিনি এ কথাও শুনেছেন যে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলকে মেরে ফেলা হবে। পরে বঙ্গভবনেই শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফকে সেনানিবাসের কথা জানিয়েছিলেন। রাত বারোটার দিকে ‘সিপাইদের বিপ্লব’ শুরুর কথা ফোনেই জেনেছিলেন শাফায়াত জামিল। কিন্তু তখন আর কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল না তাদের। ওই রাতেই মুক্ত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। রাত তিনটার দিকেই টেলিফোনে বঙ্গভবনে কথা বলেছেন কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাথে। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন “Forgive and forget, let’s unite the Army.” কিন্তু জিয়াউর রহমানের সেই চাওয়া পূরণ হয়েছিল কি? আর তার এই মনোভাবের পরও ৭ নভেম্বর সকালে নিহত হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও মেজর হায়দার। (চলবে… )
(৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবর মাস জুড়ে ‘ডিবিসি’ টেলিভিশনে আট পর্বে ‘উপসংহার’ নামে একটি টক-শো করেছেন ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা। সেই টক-শোতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং অন্যান্য বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি চ্যানেল আই অনলাইন’র জন্য এ ধারাবাহিকটি লিখছেন। টক-শো’র মতো এখানেও তিনি সবার চোখ দিয়ে ৭৫’র নভেম্বরের ঘটনাগুলোতে দৃষ্টিপাত করে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।)