তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস ও সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নাসিমের মধ্যে আগে থেকে চলা দ্বন্দ্ব ১৯৯৬ সালের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে চরম আকার ধারণ করে। দুজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রপতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সেনাপ্রধান চার সেনা কর্মকর্তাকে সংযুক্ত (অ্যাটাচমেন্ট) করেন। পাল্টাপাল্টি অবস্থানের এ বিষয়টি গড়ায় উভয়পক্ষের সেনাদের মুখোমুখি অবস্থান পর্যন্ত।
রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান উভয়ই নিজেদের অনুগত কর্মকর্তার মাধ্যমে সেনাদের মার্চ করিয়ে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি অনুগত বাহিনী পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিলে আটক করা হয় সেনাপ্রধান নাসিমসহ সাত উর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তাকে। আটকের আগেই জেনারেল নাসিমকে সরিয়ে সেনাপ্রধান করা হয় লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে।
জেনারেল নাসিম এবং তার অনুগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ কথিত অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। মোট ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে তদন্ত আদালত গঠনের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাত জনকে বরখাস্ত এবং আট জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
লে. জেনারেল নাসিমের সঙ্গে আটক হওয়া অন্য কর্মকর্তারা ছিলেন: ময়মনসিংহ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আয়েনুদ্দিন এবং তার অধীনস্থ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিল্লুর রহমান, বগুড়া ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান এবং তার অধীনস্থ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফি মেহবুব, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুর রহমান এবং ঢাকা সেনানিবাসের একটি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু বক্র।
জেনারেল নাসিম কী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন? নাকি সেনাবাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে তার অনুগত সেনাদের ঢাকা অভিমুখে রওনা হতে বলেছিলেন?
রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও তার অনুগত সেনা কর্মকর্তাদের দাবি, নাসিম তার অনুগত সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গভবন দখল করতে চেয়েছিলেন, যে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় রাষ্ট্রের অনুগত সেনা কর্মকর্তারা।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তখন সরাসরি যুক্ত ছিলেন ডিজিএফআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এমএ মতিন, ৯ম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান, মেজর জেনারেল সুবিদ আলি ভুঁইয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রহিম এবং ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম।
অন্যদিকে লে. জেনারেল নাসিম এবং তার অনুগত কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের সকল প্রচেষ্টা ছিল বাহিনীর ওপর রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড রক্ষা করা।
নাসিমসহ সাত সেনা কর্মকর্তাকে আটকের তিন দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ২১ দফা যুক্তি তুলে ধরে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ আনে। একটি জাতীয় দৈনিক সেই বিবৃতি ছাপা হয় মে মাসের ২৫ তারিখে।
আটক সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়: এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে সরাসরি জড়িত সাত জন উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারকে বিচারের জন্য সেনা আইনের আওতায় আটক রাখা হয়েছে।
ওই ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিশ্বস্ত ও অনুগত ডিজিএফআই’র তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এমএ মতিন দাবি করেছেন, জেনারেল নাসিমের মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভবন দখল করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা।
জেনারেল মতিনের দাবি, ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে লে. জেনারেল নাসিম খুব অল্প সময়ের নোটিশে প্রশিক্ষণ ও পয়েন্টস আলোচনার নামে ফরমেশন অফিসারদের যে কনফারেন্স ডেকেছিলেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ব্যাপারে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা।’
’৯৬ সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল’ শীর্ষক নিবন্ধের প্রতিবাদলিপির একটি পর্যায়ে জেনারেল মতিন লিখেছেন: কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেনাপ্রধান আমাদের জানান যে, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে কিছু সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু সিনিয়র অফিসারদের সাথে কথাবার্তায় উস্কানিমূলক ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদান করছেন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিগ্রহণ তথা মার্শাল ল জারি করার জন্য প্রলুব্ধ করছেন।
তিনি এ বিষয়ে নাম উল্লেখ না করে নিকট অতীতে মেয়ের বিয়ের কার্ড বিতরণ উপলক্ষে একজন সিনিয়র অফিসারের সেনাসদরে আগমন এবং কর্মরত অফিসারদের কথাবার্তার অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করার কথাও উল্লেখ করেন।
স্বভাবতই এরপর এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আমাদের আমাদের সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ প্রদানপূর্বক সেনাপ্রধান আলোচনার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করবেন- এটাই আমাদের কাম্য ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম তা না করে আলোচনা দীর্ঘায়িত করেন।
‘ওই ধরনের (মার্শাল ল জারি) একটি কাল্পনিক অথচ স্পর্শকাতর বিষয়কে এমন ধরনের একটি ফোরামে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করার পেছনে যে কোন অশুভ ইঙ্গিত আছে- তা আমাদের কারোরই বুঝতে কষ্ট হয়নি,’ লিখেছেন জেনারেল মতিন।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কয়েকদিন আগে একটি গাড়িতে নারায়ণগঞ্জসহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শন শেষে নারায়নগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার পথে জেনারেল নাসিমের সঙ্গে কথোপকথনে মার্শাল ল জারির ব্যাপারে নাসিমের আগ্রহ লক্ষ্য করেছেন বলেও দাবি করেন জেনারেল মতিন।
তবে একই ঘটনায় লে. জেনারেল নাসিম আবার জেনালের মতিনের বিরুদ্ধেই পাল্টা অভিযোগ করেন। লে. জেনারেল নাসিম তার ‘আমি জেনারেল নাসিম বলছি’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন:
মুন্সীগঞ্জে পরিদর্শনে যাওয়ার সময় জেনারেল মতিন আমার সঙ্গে একই গাড়িতে যান। পথিমধ্যে বিবিধ আলোচনার সময় এক পর্যায়ে জেনারেল মতিন অনেকটা এরকম একটি কথা বললেন, ‘স্যার, পরিস্থিতি যেভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে আমদেরকে দেশের দায়িত্ব নিতে হতে পারে।’
তিনি লিখেছেন: জেনারেল মতিনকে অনেকটা এরকম উত্তর দিই, আমরা রাজনীতিবিদ নই, জনগণও আমাদের কোন ক্ষমতা দেয়নি এবং আমাদের দেশের দায়িত্ব নেবার কোন অধিকার নেই।’
জেনারেল মতিন এ ঘটনাটিকে ‘চাতুরতার সাথে সম্পুর্ণ উল্টোভাবে’ নাসিমের বক্তব্য বলে চালিয়ে দেন বলে দাবি করেন জেনারেল নাসিম।
লে. জেনারেল নাসিম এবং জেনারেল মতিন উভয়ই অবশ্য তাদের কথোপকথনের সময় একজন ক্যাপ্টেন এবং গাড়িচালকের উপস্থিতির কথা বলেছেন।
১৮-২০ মে’র ঘটনার জন্য লে. জেনারেল নাসিম রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তার বইয়ে লিখেছেন:
আমি সন্দেহ করলাম রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সেনাবাহিনীর ওপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছেন এবং সমগ্র জাতির সামনে এটা দেখাতে চাচ্ছেন যে, পুরো সেনাবাহিনী তার কমান্ড অর্থাৎ নির্দেশ মোতাবেক চলছে। রাষ্ট্রপতির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল , দেশে জরুরি অবস্থা জারি হোক যাতে পুর্ববর্তী জাতীয় সংসদকে (১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন) পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস সৃষ্টি করা যায়।
ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় সেনা আনার নির্দেশ দেওয়া প্রসঙ্গে নাসিম লিখেছেন:
রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস কর্তৃক আইন বহির্ভূত নির্দেশ এবং মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান এবং ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম কর্তৃক সৃষ্ট অবাধ্যতা ও বিদ্রোহমূলক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
‘সেনাবাহিনীর স্বার্থে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং নিরাপত্তার জন্য ঢাকার বাইরে অবস্থিত বিবিধ সেনানিবাসে অবস্থিত ডিভিশন থেকে ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসদ্বয়ে কয়েকটি সেনাদল আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’
এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা মনে করেন, জে. নাসিমের বঙ্গভবন দখলের ইচ্ছা থাকলে তার সামনে সবচেয়ে ভালো সুযোগ ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময়। কারণ তখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু ১৮-২১ মে সংঘটিত ঘটনাবলির সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল।
তাছাড়া অভ্যুত্থান ঘটানোর কিছু প্রাথমিক লক্ষণ থাকে, যেমন রাষ্ট্রীয় টিভি-রেডিও স্টেশন দখল, বঙ্গভবন ঘেরাও ইত্যাদি। যা জেনারেল নাসিমের কর্মকাণ্ডে পরিলক্ষিত হয়নি।
তত্ত্বাবধায় সরকারের তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানও কখনও নাসিম এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনেননি বলে চ্যানেল অনলাইনকে জানিয়েছেন তার সঙ্গে সরাসরি এ বিষয়ে কথা হয়েছে এমন একজন সাংবাদিক।
পরবর্তী কিস্তি: যে কারণে সেনাবাহিনীতে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল