চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্তুতিমূলক বই অনেক থাকলেও নেই পর্যাপ্ত গবেষণা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্তুতিমূলক বইয়ের ছড়াছড়ি থাকলেও গবেষণা কর্ম খুব একটা হচ্ছে না বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট গবেষক ও ইতিহাসবিদরা। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, গবেষণা না হলে তাঁর নামে হাজারও ভবন, সড়ক কিংবা অন্য যা কিছু করা হোক না কেনো, জাতির এই অবিসংবাদিত নেতার নীতি, আদর্শ ও কর্মময় জীবন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া ও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শ বিষয়ে গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে তারা বলছেন, গবেষণাই পারে একটি আদর্শকে যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখতে, যা বিশ্ব সভ্যতাগুলোর দিকে তাকালে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

১৭ মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এই দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

জাতির মর্যাদাপূর্ণ এই দিনটিকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ নিয়ে কেমন গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে এবিষয়ে কথা বলতে গেলে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ইতিহাসবিদ ও গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোবদ্ধ গবেষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় বাঙালি সভ্যতা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি’।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বিবিসির জরিপে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কুড়ি জন বাঙালির তালিকায় শীর্ষ স্থান করে নিয়েছিলেন। এই জরিপটি জনমত অনুযায়ী হয়েছিল। সুতরাং জনমত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এটা বাংলাদেশের কোনো জরিপ নয়। অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য মানের একটি সংবাদ সংস্থার জরিপ। সেক্ষেত্রে আমাদের বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এমন একজন মানুষকে আমরা জাতির জনক হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু জাতির জনকের জীবন, কর্ম ও নীতি নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন ছিল তা খুব একটা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে এবং গবেষণা গ্রন্থও বের হয়েছে। কিন্তু সিংহ ভাগ যাকে বলা যায় স্তুতিমূলক। তাকে বায়োগ্রাফি বলা যায় না। এই জন্য আমরা এখনো অপেক্ষমান যে, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নমূলক গবেষণা যেন হয়।

অধ্যাপক হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে এক মার্কিন অধ্যাপককে অন্তত নিয়ে এসেছিলো বঙ্গবুন্ধুর জীবনী লেখানোর জন্য। কিন্তু সেই কাজটি হয়নি। আমি মনে করি বিদেশিদেরকে দিয়ে বঙ্গবন্ধূর জীবনী লেখানো খুব একটা সম্মানজনক নয়। বাংলাদেশেই অনেক ভালো গবেষক আছেন। ইংরেজি ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষতা আছে। তাদেরকে নিয়ে যদি আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে সচেষ্ট হয় আমি মনে করি যে, বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি গবেষণাগ্রন্থ বেরিয়ে যাবে, যা নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে বিবেচিত ‍হবে।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ এদিকে খুব একটা ঐকান্তিকতার পরিচয় এখনো  দিতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে কিনা জানি না। তবে উচিত। কারণ বঙ্গবন্ধূকে নিয়ে রাজনীতি হয়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যবসা হয়”।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর অনেক বই আছে। তবে অধিকাংশ বই-ই চর্বিতচর্বণ। গবেষণামূলক বইয়ের অনেক সংকট। তার মতো মানুষকে নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা প্রয়োজন ছিলো তা হচ্ছে না।

অধ্যাপক মুনতাসির মামুন

তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার জন্য একটি উদ্যোগ ছিলো বঙ্গবন্ধূ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। অধ্যাপক বুরহান উদ্দীন জাহাঙ্গীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে এটি ১৯৯৯ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।সেখানে বিরাট একটি আর্কাইভ চালু করেছিলাম। একটি উন্নতমানের যাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তার জন্য বঙ্গবন্ধুর একটি টেলিগ্রাফও সংগ্রহ করেছিলাম। এখন সেটিরও কোন খবর নেই। কী অবস্থায় আছে তাও জানি না।

বিশিষ্ট গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেছবাহ কামাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাজার খানেক বই আছে জানিয়ে বলেন: তা থাকলেও সত্যিকার অর্থে গবেষণা বইয়ের সংখ্যা খুব নগণ্য। এর মধ্যেও আবার একধরণের ভাবের উপস্থাপনা, যা স্তুতিমূলক।

তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ও অনুকরণীয় ছিলেন। একইভাবে যদি তাকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাহলে সেভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

অধ্যাপক মেছবাহ কামাল

অধ্যাপক মেছবাহ কামাল বলেন, পরবর্তী প্রজন্মের প্রয়োজনে, ইতিহাসের প্রয়োজনে জতির পিতাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে এখন তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা নেই। ব্যক্তিগতভাবে কিছু কিছু গবেষণা হয়। কিন্তু সেগুলোও বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসমূলক। সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন, নীতি ও কর্মের ওপর গবেষণা হচ্ছে না মনে করেন তিনি।

প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার জন্য একটি উদ্যোগ ছিলো বঙ্গবন্ধূ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মুনতাসির মামুন।দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় এলে সেটি আর বেশিদূর যায়নি বলে জানান মেছবাহ কামাল।

তিনি বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর আমরা আশা করেছিলাম প্রতিষ্ঠানটির কর্মযজ্ঞ ব্যাপকারে শুরু হবে, কিন্তু তা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নামে দালান নির্মাণের চেয়ে তার জীবন, কর্ম ও আদর্শের ওপর গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। গবেষণার দিক দিয়েও দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জড়িত থাকার দায়ে তৎকালিন প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব বাতিল করেছিল। তবে ৬১ বছর পর ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এর নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে  তাঁকে নিয়ে কী পরিমাণ গবেষণাকর্ম হয়েছে তা জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ানের অফিসকক্ষের কম্পিউটারে ক্যাটালগ সার্চ করে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে ৪০২ টি বই সংরক্ষিত থাকলেও কোন গবেষণা গ্রন্থ নেই। পরে এমফিল ও পিএইচডি নিবন্ধিত করার খাতায় খোঁজ করে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ওপর সুনির্দিষ্ট মাত্র একটি গবেষণা পত্র আছে। সেটিও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। “স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অবদান’ শিরোনামের গবেষণাটি করেছেন মো. আশিকুর রহমান।

এবিষয়ে লাইব্রেরিয়ান অধ্যাপক ড. এস এম জাবেদ আহমেদ বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে গবেষণার জন্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গবেষকদের সহায়তা করা। আমরা তার জন্য প্রস্তুত আছি। গবেষণার দায়িত্ব ছাত্র-শিক্ষকদের। তারা যদি গবেষণায় এগিয়ে না আসে তাহলে বঙ্গবন্ধূ সম্পর্কে হয়তো আমাদের অনেক কিছূই জানা হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঐতিহ্য এবং ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা, সে তুলনায় গবেষণা নেই। বঙ্গবন্ধুর ওপর অনেক বেশি গবেষণা হওয়া জরুরি বলছেন তিনিও।       (এস.এম জাবেদ আহমেদ)

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে  কাজ করে বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে অনেক বই প্রকাশ করে থাকে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর কী পরিমাণ গবেষণা আছে জানতে ফোনে কথা হয় মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মের ওপর আমরা অনেক বই প্রকাশ করি।  গবেষণা বইও প্রকাশিত হয়। তবে কি পরিমাণ গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে তার সঠিক হিসাব দিতে গেলে সময়ের প্রয়োজন পড়বে।সঠিক তথ্য নিয়ে বলা দরকার, যা এই মুহর্তে বলতে পারছি না’।

 

ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এর সঙ্গে। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত ৫৫ বছরের জীবনে বহু ঘটনা আছে, বহু মুহুর্ত আছে। এগুলো আমাদের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। কারণ অন্যান্য নেতা যারা ছিলেন তারা ইতিহাস থেকে সৃষ্ট। আর বঙ্গবন্ধুর জীবন মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সেই কারণে ইতিহাস গবেষণায় বঙ্গবন্ধু ফিরে ফিরে আসবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা।

উপাচার্য বলেন, আমরা বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করলে যেমন বঙ্গবন্ধু আসবে, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করলে সেখানে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে কারণে এখানে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য আমার মনে হয় সব বিভাগেই প্রযোজ্য। বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান, কলা অনুষদের বিভাগুলো। কেননা বঙ্গবন্ধুর অবদান বহুমাত্রিক-বলছিলেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক।

নতুন প্রজন্ম বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য উদঘাটন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে ঢাবি উপাচার্য বলেন, এসব গবেষণা আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে, স্থায়ীত্ব দিবে এবং নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবোধকে জাগ্রত করবে। তিনি বিগত অর্থ বছরের চেয়ে সামনের দিনগুলোতে গবেষণার জন্য বাজেট বৃদ্ধি করা হবে বলে জানালেন।

তবে সবকিছুর মাঝে যে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে সেটি হলো, বঙ্গবন্ধুর নামে অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শের ওপর গবেষণাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা।