চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ফেসবুকের ওপর নিয়ন্ত্রণ, বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো

ফেসবুক দুনিয়ায় এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে গেছে ১১৫ কোটি অ্যাকাউন্ট। চীন আর ভারতের পরে এটাই সবচেয়ে বড় দেশ। যেভাবে বাড়ছে তাতে আর মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে সংখ্যার বিচারে ছাড়িয়ে যাবে এই দুই দেশকেও।

ফেসবুক যে পৃথিবীর সবেচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া সেটি নিয়ে তর্কের আর দরকার পড়ছে না। কিন্তু মাধ্যমটি মানুষকে যুক্ত করা, কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি বিষবাষ্পও কি ছড়াচ্ছে না?

উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ-সবই চলছে এখানে। আর তাতেই কপালের ভাঁজ খানিকটা হলেও ঘন হচ্ছে।

ফেসবুক তো কখনো কখনো, কোথাও কোথাও ঢিলা করে দিচ্ছে প্রভাবশালী সরকারের শক্ত গিটও। এসব নিয়েই দুনিয়া জোড়া আলোচনা। আর শাসকগোষ্ঠীর দুশ্চিন্তা।

বাংলাদেশেও যে প্রভাবের ঢেউ বড়সড় হয়ে আছড়ে পড়েছে এর বড় উদাহরণ শাহবাগের আন্দোলন। বৈশ্বিক উদাহরণ মিসরের তাহরির স্কয়ার।

বাংলাদেশে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দুই কোটির কিছু বেশী। সঠিকভাবে বললে, আগস্টের শেষে এসে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ। প্রতিদিন ছেলে-বুড়ো অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন এই নেটওয়ার্কে। হিসেবে বলছে মিনিটে পাঁচটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশী। তাতে ফেসবুকের ব্যবসার প্রসার ঘটছে। আবার সরকারের দুশ্চিন্তার প্রসার হচ্ছে।

শুধু এই কারণেও মাধ্যমটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও এখন আসছে জোরেশোরে, বাংলাদেশ মানের অন্য আট-দশটা দেশের মতোই। ভয় ফেসবুক যেনো দেশের মধ্যে আরেকটা দেশ না বানিয়ে ফেলে।

আমরা তো আর জার্মানি নই যে, তাদের অফিসে গিয়ে শুধু অনুরোধই করবো যাতে বিষবাষ্প না ছাড়ায়। আমরা তো প্রয়োজন দেখি এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেটাকে গলা টিপে বন্ধ করার দেওয়ারও। বন্ধ তো করেছি গত বছরের নভেম্বরে। কারণটা সবারই জানা। এর আগে ২০১২ সালে প্রায় এক বছর বন্ধ হয়েছিল ইউটিউবও।

বন্ধ করে দেওয়া যে সমাধান নয় সেটা বুঝে বা না বুঝেই বিষয়টি নিয়ে শত কোটি টাকার প্রকল্প সাজছে। উদ্দেশ্য কিভাবে এইসব জন-গন মাধ্যমকে ঘরে বসেই ফিল্টার করে ফেলা যায়। যাতে চাইলেও যেন আটকে দেওয়া যায় যেটা ইচ্ছা।

জার্মানির প্রসঙ্গ কেনো আনলাম সেটা বলি। দিন কয়েক আগে বার্তাসংস্থা রয়টার্স রিপোর্ট করেছে দেশটির ইন্টোরিয়ার মন্ত্রী, আমাদের দেশে যাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে; তিনি গিয়েছেন তাদের দেশের বার্লিনে থাকা ফেসবুকের অফিস পরিদর্শনে। সেখানে তিনি বলে এসেছেন, ফেসবুক যেন অবাঞ্ছনীয় কনটেন্ট যতো দ্রুত সম্ভব মুছে ফেলতে আরো কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

মন্ত্রী মানুষ, তিনি সে কথা বলতেই পারেন। তার ওপর এতোবড় দেশের মন্ত্রী। তার জন্যে এটা বলা আরো সহজ যে তাদের দেশে ফেসবুকের একটা অফিস আছে বলে। কিন্তু আমারা তো ফেসবুক দুনিয়ার দুই শতাংশের বেশী গ্রাহক থাকার পরেও ফেসবুকের একটা অফিসও ঢাকায় আনতে পারছি না।

দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছাড়ানো ফেসবুকের ২৩টা অফিস আছে। বাড়িপাশের দিল্লী ছাড়াও, সিঙ্গাপুর, হংকং, সিউল, টোকিওতের অফিস আছে তাদের। তারানা মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকের দরজায় কয়েক দিন কড়াও নাড়লেন। কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। শেষে কিনা ফেসবুক ফিল্টারিংয়ের প্রকল্প সাজছে।

জার্মানিতে অভিবাসীরা যেন সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত না হয় সে জন্যে তাদের উদ্যোগ। ফেসবুক জাতি হিসেবে তারা বিশ্বের অষ্টম স্থানে। তাদের হাতে আছে তিন কোটি ৬৮ লাখ অ্যাকাউন্টের সম্ভার। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১৭। একটু পিছিয়ে। কিন্তু জনসংখ্যা বলছে, সুযোগ আছে জার্মানি কেনো, দুই কোটি ১৪ লাখ অ্যাকাউন্ট নিয়ে পঞ্চদশ অবস্থানে থাকা স্পেন থেকে শুরু করে উপরে দিকে থাকা কানাডা (দুই কোটি ২৪ লাখ), ইতালি (দুই কোটি ৮২ লাখ), জাপান (দুই কোটি ৮২ লাখ), ফ্রান্স (তিন কোটি তিন লাখ), তুরস্ক (তিন কোটি ৩১ লাখ), ইংল্যান্ডকে (তিন কোটি ৬৫ লাখ) সহজে টপকে যাওয়ার।

জার্মানির ঠিক ওপরেই আছে ফিলিপিন (তিন কোটি ৯৮ লাখ) বা মেক্সিকোকে (চার কোটি ৬০ লাখ) টপকে যাওয়ার।

আর সবার ওপর ভারত ১৯ কোটি ৫২ লাখ অ্যাকাউন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ১৯ কোটি ১৩ লাখ, ব্রাজিলে ৯ কোটি, ইন্দোনেশিয়ায় ৭ কোটি ৭৮ লাখ, বা চীনের ৫ কোটি ২৯ লাখ অ্যাকাউন্টের।

চীনে তো ফেসবুক একরকম নিষিদ্ধ। তারপরেও সেখানে পাঁচ কোটি অ্যাকাউন্ট হয়ে গেছে। এই উদাহরণের সঙ্গে সঙ্গে গত বছরের নভেম্বরে ফেসবুক বন্ধ থাকার সময়কার উদাহরণ বলছে ফেসবুককে নিষিদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। বিকল্প বেরুবেই।

পরের নামগুলোর সঙ্গে তুলনা না হতে পারে। কিন্তু আগেরগুলোকে তো টপকে যেতে পারি সহজেই। সম্ভাবনার এই জায়গা থেকেও ঢাকায় ফেসবুকের একটি অফিস জরুরী। সেটা হলে অন্তত ফিল্টারিংয়ের নামে দেড়শ কোটি টাকার প্রকল্প সাজাতে হবে না। হয়তো কেবল অনুরোধেই অনেক বেশী কাজ হয়ে যাবে।
ফিল্টারিংয়ের চেষ্টা কেনো হচ্ছে সে সম্পর্কে আগবাড়িয়ে কোনো ধারণা করতে চাই না। কিন্তু না চাইলেও চিন্তা কি আর দূরে রাখতে পারি। ১৫২ কোটি টাকার প্রকল্প। এবার পরিকল্পনা কমিশন ঘুরে এসেছে। আবারো যাবে হয়তো তাড়াতাড়ি।

এর মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা ফিল্টার করা যাবে। অসাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদের উস্কানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

একই সঙ্গে আটকে দেওয়া যাবে ভিন্নমত আর রাজনৈতিক প্রচারও। ফেসবুক তো আর বোঝে না কোনটা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)