ঢাকার মাটিতে কৃত্রিম আলোয় প্রথম হকি ম্যাচ। হকি মাঠে বিরল দৃশ্য, গ্যালারি ভর্তি দর্শক। বাংলাদেশ হকি দলকে উজ্জীবিত করতে যা যা প্রয়োজন সবই করলেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। কিন্তু ম্যাচ শেষে ফিরতে হল মলিন মুখে। পাকিস্তানের কাছে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত, পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষেও একই ব্যবধান। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে ৩-১এ হার। ৩২ বছর পর দেশের মাটিতে বসা হকি এশিয়া কাপের দশম আসরে বাংলাদেশের চালচিত্র এমন মনখারাপ করাই। গোল আর ফলের খেলার এমন চিত্র বলবে জিমিদের দল আশাজাগানিয়া লড়াই উপহার দিতে ব্যর্থ একেবারেই। কখনও অবশ্য দারুণ শুরুর পরও শেষঅবধি স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে পারেনি। প্রস্তুতির ঘাটতি তাতে চোখে পড়েছে আতশ কাচ ছাড়াই। অথচ এই বাংলাদেশই টুর্নামেন্টের কয়েকদিন আগে জাপানকে হারিয়ে দিয়েছিল প্রস্তুতি ম্যাচে। আশার ফানুসটা উড়েছিল তাতেই। ১৭ গোল হজমের গ্রুপপর্বে সেটি ফুটো হতেও সময় লাগেনি। কেন এমন বিপর্যয়? হার-জিতকে সরিয়ে রেখে দেশের হকি কাঠামোর দিকে নজর দিলে অনায়াসেই বেরিয়ে আসবে অন্ধকার গর্তগুলো! শুধু একটা তথ্য দিলেই দৈন্যদশার পঞ্চাশভাগ সামনে চলে আসবে, সেটা হকি লিগ নিয়ে। কোন দেশের শক্তিশালী জাতীয় দল গঠনের জন্য শক্তিশালী ঘরোয়া লিগ আয়োজন যেখানে অপরিহার্য, সেখানে লিগ আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের হকি খেলোয়াড়দের আন্দোলনে নামতে হয় প্রায়শই। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে হকি নিয়ে আলোচনা নেই, এমন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো খেলার বাইরের বিষয়ে ভরপুর। ফেডারেশন কর্তাদের তিক্ত সম্পর্কের নগ্ন বাজারজাত, ফেডারেশনের নির্বাচন নিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা খবর হয় নিয়মিত। ঘরোয়া লিগ বন্ধ থাকে দিনের পর দিন, খেলা বিষয়ক আলোচনাও থাকে এসবের আড়ালে ঢেকে। গত ৫ বছরে বাংলাদেশ হকির ঘরোয়া লিগ মাঠে গড়িয়েছে মাত্র ২ বার, যার একটিতে সংগঠকদের দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাবগুলো লিগ বয়কট করেছিল। লিগটি হয়েছিল ৭টি মাত্র দল নিয়ে। তার ২৭ মাস পর হয়েছে আরেকটি লিগ। সেটিও খেলোয়াড়দের আন্দোলনের মুখে। তারপর পেরিয়ে গেছে লিগহীন আরও ১৮টি মাস। যেখানে ঘরোয়া লিগই হয় না, সেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য প্রতিভা খোঁজা ও গড়ে তোলার প্রক্রিয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত পথে এগোয় সেটা বুঝতে খুব বেগ পেতে হয় না। বাংলাদেশের হকি হয়ে পড়েছে তাই টুর্নামেন্ট নির্ভর। কোন টুর্নামেন্ট দুয়ারে কড়া নাড়লে চেনাজানা নামজুড়ে একটা দল গঠন করে দেয়া হয়। তারা কিছুদিন একসঙ্গে অনুশীলন করে। এই সামান্য সময়ে না ঠিক করা যায় ফিটনেস, না শুধরে নেয়া যায় ভুল-ত্রুটিগুলো। বড় দলগুলো তো বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতেই চায় না বলে এশিয়ার কাপ ব্যর্থতার পর ফলাও করে জানিয়ে দিলেন দলের ম্যানেজার। খেললেই না ভুল-ত্রুটি শোধরানোর প্রসঙ্গ আসবে। ফল, আধুনিক হকির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না প্রবল সম্ভাবনার জিমি-চয়নরা। স্কুল হকির একটা টুর্নামেন্ট অবশ্য হয়। সেখান থেকে আগ্রহী সম্ভাবনাময় তরুণরা বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাদের যত্ন নিয়ে পরের ধাপগুলো পেরিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা নেয় না ফেডারেশন। সত্যিটা হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিকেএসপি যদি সাপ্লাই না দিত, এতদিনে হকির জাতীয় দল গড়ার মত পর্যাপ্ত খেলোয়াড়ও খুঁজে পাওয়া যেত না। এসব উদাসীনতার মাশুল গুণেই এশিয়া কাপের দশম আসর দেখিয়ে দিল সময়ের পরিক্রমায় কতটা লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে একসময় এশিয়ান প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে দাপটের সঙ্গে খেলা দেশের হকি দল। হকির সুদিন ফেরাতে কাজ করার কথা যাদের, সেই ফেডারেশনই তো লাইনচ্যুত। সর্ষেতেই যখন ভূত, অব্যবস্থাপনার রোগ সারার কাজটা তখন করবে কারা? তারপরও আশা থাকে, এক ঝাঁক প্রতিভাধর খেলোয়াড়ের দিকে তাকিয়ে; তারা যদি সঠিক নির্দেশনা-যত্ন পায়, নতুন সূর্যোদয় সম্ভব। সেজন্য মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটে ফাঁস হয়ে পড়া হকির দৈন্যদশা সারাতে সদিচ্ছাটা দেখাতে হবে এখনই। নয়তো একসময়ে দেশের ক্রীড়াবাজারে তুমুল দাপটে মাঠ মাতানো ফুটবলের মতই দশা হবে হকিরও। ফুটবল তো ডুবেছে, হকির কেবল ছিঁড়েছে নোঙর। ভাঙা নাও, ছেঁড়া পাল, আরও গভীর দুর্বিপাকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই হুঁশ ফেরাটা জরুরি।