ব্রাজিল থেকে: শৈল্পিক ও নান্দনিক ফুটবল ও কালো মানিক পেলের দেশ ব্রাজিল। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল বলতে ল্যাটিন ফুটবল বুঝতাম, আর্জেন্টিনা ব্রাজিল একসময় স্বপ্নের দেশ ছিলো, সেই ব্রাজিলের আজ আমি অভিবাসী।
২০১৫ সালে দালালের মারফতে সাত দেশ ঘুরে ব্রাজিলে পদার্পণ করি।
প্রথমে গায়ানা সীমান্তবর্তী আমজন জঙ্গলের আওতাভুক্ত রোরাইমা রাজ্যের (Roraima State) রাজধানী বোয়াভিস্টা (Boa Vista) শহরে আমাকে নিয়ে আসে, এখানে একটি মজার ব্যাপার হলো প্রথম প্রথম আমার ব্রাজিলের খাবার ভালো লাগতোনা, ব্রাজিলের প্রচুর আমগাছ আছে সারা বছর আম ধরে, ঐসময়ও আমাদের যে বাসায় রেখেছে ওটার পাশে আমগাছ গুলোতে প্রচুর আম ধরেছে, আম পেকে গাছের নিচে পড়ে আছে অথচ খাওয়ার লোক নেই, আমরা অনেক গুলো আম কুড়িয়ে এনে রুমে রাখলাম, আমার সাথে টাঙ্গাইলের একজন ছিলো, আমরা দুইজন মিলে খেতাম, খুব মিষ্টি অনেকটা আমাদের দেশের মতো।
এখানে সতেরো দিন থেকে শরনার্থী হিসেবে কাগজ পত্র বানানো হয়ে গেলে Boa Vista থেকে বিমান যোগে সোজা প্যারাগুয়ের সীমান্ত লাগোয়া ও আটলান্টিক মহাসাগর সংলগ্ন রাজ্য পারানা (Parana State )র লন্ড্রিনা শহরে (Londrina) পাঠায়, ওখানে পুরো কাগজ পত্র ঠিক করে একটি হালাল খাদ্য প্রক্রিয়া জাত কোম্পানীতে চাকরি দেয়।
মজার ব্যাপার হলো ব্রাজিলে চাকরি করলে মাসে দুইবার বেতন মেলে, প্রথমে মাসের ছয় তারিখে এবং দ্বিতীয় বেতন মাসের ২২ তারিখে, সম্পূর্ণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়, চাকরির শুরুতেই স্থানীয় ব্যাংকে একাউন্ট খুলে ক্রেডিট কার্ড বানিয়ে দেয়। আরেকটি ব্যাপার হলো এখানে চাকরিতে সম পদে স্থানীয় ব্রাজিলিয়ান ও অভিবাসি শ্রমিকদের বেতন সমান সমান, খাবারের দাম মোটামুটিভাবে আমাদের দেশের তুলনায় সস্তাই বলা যায়, শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত পারানা খুবই ধনী রাজ্য। এই রাজ্যে শিল্প কারখানা প্রচুর, তবে স্থানীয় মুসলমান না থাকায় বিদেশী বিনিয়োগকৃত হালাল খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানীগুলোতে অভিবাসী মুসলিম শ্রমিকদের চাহিদা আছে।
আমি যেখানে থাকতাম(লন্ড্রিনা) ওখানে আমরা প্রায় দেড়শ জনের মতো বাঙালি ছিলাম, সবাই বিভিন্ন কোম্পানীতে কর্মরত শ্রমিক, বেশীরভাগরই বাড়ি সিলেটে। আমরা নিজেরা নামাজ পড়ার জন্য একটি বাসা ভাড়া নিলাম। ওখানে শুক্রবারে জুমার নামাজ হতো। আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির (অভিবাসী শ্রমিকদের) মধ্যে দুই জন আলেমও ছিলেন। ওনারা খুতবা দিয়ে নামাজ পড়াতেন। বাকি ওয়াক্তের নামাজ আমরা বাসায় পড়তাম।
এখানে ঈদের নামাজের জন্য শহরের মেয়রের অনুমতি নিয়ে আমরা বাংলাদেশি কমিউনিটি একটি খেলার মাঠে কার্পেট বিছিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। জুমার নামাজের মতো ঈদের নামাজের ইমামও আমাদের মধ্য থেকেই ছিলেন। লন্ড্রিনাতে তিনটা ঈদ করেছিলাম।
তারপর আমি সাও পাওলো চলে আসি। লন্ড্রিনাতে আমি যে কোম্পানীতে চাকরি করতাম ওখান থেকে রিজাইন দেওয়ায় আমাকে এককালীন কিছু নগদ টাকাও দেয়া হয়। ব্রাজিলের নিয়ম অনুসারে, চাকরি ছাড়লে চার মাসের বেতন প্রতি মাসের শেষে আমার একাউন্টে চলে আসতো। সাও পাউলো এসে ওই টাকার সঙ্গে আরো কিছু টাকা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে নিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়ি।
সাও পাওলোর বেশীরভাগ বাংলাদেশি ছোটোখাটো ব্যবসা করে, ব্রাজিলিয়ান অর্গানাইজারদের মাধ্যমে সাও পাওলো থেকে ব্রাজিলের বিভিন্ন রাজ্যের শহরে বাস ভর্তি মাল নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে।
প্রতি বৃহস্পতিবার সাও পাওলো শহরের ব্রাস (bras) নামক স্থান থেকে বিভিন্ন রাজ্যের উদ্দেশ্যে ২০ থেকে ২৫ টি বাস ছাড়ে। বাসে আমাদের বাংলাদেশিদের সাথে ব্রাজিলিয়ান সহ সেনেগালি, বলিভিয়ান, পাকিস্তানি, চায়নিজরাও থাকে। মেলা তিনদিন ধরে চলে, শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত। তাই আমরা বৃহস্পতিবার বিকেলে মালপত্র গোজগাজ করে রাতেই রওয়ানা দিতাম। এটাকে আমরা ‘ফেরিয়া’ বলি।
ফেরিয়ার আওতায় পুরো ব্রাজিলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল হলেও আমি সাও পাওলো (Sao Paulo State) রাজ্যের বিভিন্ন শহর সহ আশেপাশের দশ টি রাজ্যে (PARANA,MINAS GERAIS,RIO DE JANEIRO,SANTA CATARINA,RIO GARANDE DO SUL,GOIAS (Brasilia), MATO GROSSO DO SUL, MATO GROSSO, BAHIA, ESPIRITO SANTO, MARANHAO) গেছি ফেরিয়া নিয়ে।
সাও পাওলো শহরে আমরা বাংলাদেশিরা বেশী সংখ্যক থাকি ব্রাসে (Bras)। এই এলাকা কিছুটা মুসলিম অধ্যুষিত। সৌদি সরকার ও ইরান সরকারের অর্থায়নে নির্মিত দুইটি বড় বড় মসজিদ আছে। তাই সাও পাওলো শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা ব্রাসে (Bras) আসে নামাজ পড়তে। অন্যান্য অভিবাসী মুসলমানের সাথে সৌদি ও ইরানি অর্থায়নে নির্মিত মসজিদ দুইটিতে নামাজ পড়তাম। রমজানের তারাবী ও ঈদুল ফিতরের নামাজ এখানেই আদায় করেছি। বেশ বড় মসজিদ, ভিতরে বাহিরে মিলে দুই তিন হাজার লোক একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে। রমজানে মাসব্যাপী মসজিদে ইফতারি বিতরণ ও ঈদের নামাজের পরও মুসল্লীদের খাবার বিতরণ করে স্থানীয় আরব বংশোদ্ভূত ব্রাজিলিয়ান মুসলমানরা। ঈদের নামাজ মসজিদ সহ আশেপাশের রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়।
সাও পাওলোর বাংলাদেশিরা মোটামুটি ভালো আছে। এখানে বাংলাদেশি মালিকাধীন রেস্টুরেন্ট সহ পাইকারি ও খুচরা দোকানপাট আছে। সাও পাওলোতে সারা বাংলাদেশের লোক পাওয়া গেলেও আমার সাথে ফেনী নোয়াখালীর প্রচুর লোকের পরিচয় হয়েছে। একেকজন একেক মাধ্যমে ব্রাজিলে এসেছে। এখন মোটামুটি সবাই ভালো অবস্থানে আছে। কেউ আমার মতো ফেরিয়া করছে, আবার কেউ এখানেই দোকানপাটসহ খাওয়ার হোটেল খুলে বসেছে।
এখানে থাকতে থাকতে অনেকে আবার নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। ব্রাজিলের অভিবাসী আইন অনুযায়ী ব্রাজিলে অবস্থিত সকল অভিবাসীর পর্যায়ক্রমে ব্রাজিলের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ব্রাজিলে বর্তমানে পাঁচ হাজারের উপরে বাংলাদেশি আছে। সবাই অবৈধ পথে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্রাজিল এসেছে। আবার এখান থেকে একটা বড় সংখ্যক বাংলাদেশি দালাল ধরে আমেরিকা চলে গেছে। সাউথ আফ্রিকায় অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ওখান থেকেও অনেক বাংলাদেশি ব্রাজিল এসে দালাল ধরে ব্রাজিল হয়ে সড়ক পথে আরো দশ দেশ ঘুরে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে।
ব্রাজিলের অর্থনীতি সব রাজ্য সমান নয়, আটলান্টিক পাড়ের রাজ্যগুলো মোটামুটি ধনী। আমি প্রথম যে রাজ্যে দিয়ে ব্রাজিল এসেছি ওটা খুবই দুর্বল বা গরীব রাজ্য ছিলো (Roraima State)। মাথাপিছু আয় আটলান্টিক পাড়ের সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরিও ও পারানার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তাই ব্রাজিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্রাজিলের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় ধনী রাজ্যগুলোতে বেশী সংখ্যক (প্রায় ৯০ ভাগ) থাকে।
ব্রাজিলে বাংলাদেশিদের সুনাম আছে। তাই আমরা বাংলাদেশের মতো চলতে পারি, কোনো প্রকার অসুবিধা নেই।
সততা আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ব্রাজিল হতে পারে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য দারুণ একটি দেশ।