চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ফজলে রাব্বীর গাড়িই জীবন বাঁচিয়েছে অনেক মুক্তিযোদ্ধার

ঢাকার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে স্বচ্ছ কাচের বক্সের ভেতর দেয়ালে ঝুলানো একটি সাদা শার্ট। তার নীচে সুদর্শন একজন মানুষের সাদা কালো একটি ছবি। দেখা মাত্রই তাকে চিনে ফেলা সম্ভব। হ্যাঁ, সুদর্শন মানুষটির নাম শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বী। কাচের বক্সটির ঠিক ডানপাশে লেখা রয়েছে ছোট করে মানুষটির বিবরণী।

একটু দূরে যত্ন করে রাখা তার পুরনো মডেলের কালো গাড়িটা। দিব্য চোখে গাড়িটি থেমে থাকলেও এটা ১৯৭১ সাল থেকে গৌরবময় এক ইতিহাস বহন করে চলেছে। কারণ নিজের এই গাড়িতে করেই ফজলে রাব্বী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতেন আর তাদের জন্য দরকারি ওষুধপত্র সরবরাহও চলতো এ গাড়িতে করেই।

তিনি নিজ হাতে হয়ত রাইফেল ধরেননি যুদ্ধ করার জন্য, কিন্তু একজন ডাক্তার হিসেবেই তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন জাতির সবচেয়ে মেধাবী চিকিৎসকের একজন।

ফজলে রাব্বীর সেই গাড়ি
ফজলে রাব্বীর সেই গাড়ি

মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে লন্ডন রয়াল কলেজের রেকর্ড গড়ে দু’দুটো বিষয়ে ডাক্তারিতে এমআরসিপি ডিগ্রী অর্জন করে তিনি ফিরে এসেছিলেন নিজের প্রিয় জন্মভূমিতে। ১৯৭০ সালে ‘পাকিস্তান বেস্ট প্রফেসর অ্যাওয়ার্ড পেয়েও হানাদারদের শোষণের প্রতিবাদে তা প্রত্যাখ্যান করতে একটুও দ্বিধা করেন নি তিনি।

ছাত্রদের খুব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ডা. ফজলে রাব্বী। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয় তার একাধিক মৌলিক গবেষণা।

১৯৭১ এর ২৬ মার্চ কালরাত্রির পর ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে পাক বাহিনী। কাউকে বাহিরে দেখলেই গুলি। এর মাঝেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডা. রাব্বী চলে আসেন তার কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। একজন চিকিৎসক হিসেবেই তিনি পাশে  দাড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের । সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশের এই সংকটে নিজের ডাক্তারি বিদ্যাটাকেই কাজে লাগাবেন তিনি। যুদ্ধের নয় মাস সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অক্লান্ত সেবা করে যান আহত মুক্তিযদ্ধাদের সাড়িয়ে তুলতে। নিজেই ওষুধ কিনে দিতেন তাদের। গেরিলা যোদ্ধাদের করতেন দরকারি অর্থ সাহায্য। কেবল তিনি নন তার স্ত্রী জাহানারা রাব্বির পাশে দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের।

বিজয়ের একেবারে অন্তিম লগ্নে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের শিকার হন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। অমানবিক নির্যাতনের পর তার বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা ছিড়ে ফেলেছিল জল্লাদের দল। মৃত্যুর পর চোখ বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে ছিল তার নিথর দেহখানা।
চাইলে লণ্ডনেই নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন স্বর্ণপদক জয়ী এ চিকিৎসক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সব ছেড়ে নিরাপদে পালিয়েও যেতে পারতেন।

কিন্তু তার বুকে ছিল গভীর এক দেশপ্রেম তার এ দেশের মানুষের জন্য সীমাহীন দায় বদ্ধতা। আর তাই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্যই।

ফজলে রাব্বি
ফজলে রাব্বীর ব্যবহার করা সাদা শার্ট, প্রেসার মাপার বিপি সংগৃহীত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে

কবিতা আর গানের প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল তার। সেই সাথে ছিল প্রচুর বই পড়ার নেশা। ফটোগ্রাফির প্রতিও ঝোঁক ছিল তার। অথচ তিনি নিজেই এখন ছবি হয়ে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এক কোণায়। পাশেই তার প্রেসার মাপা বিপি মেশিনটা।

ছবি- জাকির সবুজ