রাজাকার পলাতক ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিসকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শরীয়তপুরের পালং উপজেলার রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির নেতা ইদ্রিসের বিরুদ্ধে শরীয়তপুর-মাদারীপুরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হিন্দুদের দেশান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগ এই আদেশ দিয়েছে আদালত।
আমি খবরটা জানার পরে তক্কে তক্কে ছিলাম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কোন সংগঠন বা দেশী কেউ তার শাস্তি মউকুফের আবেদন জানায় কী না। কেউ কিছু বলেছে বলে চোখে কিছু পড়েনি আমার।
কয়েকজনকে ফোন করলাম, তারাও কিছু জানেন না। ডক্টর কামাল হোসেনের মেয়ের স্বামী সেই বিখ্যাত (!) বিদেশী সাংবাদিক মাতে না, আগের মতো। কোন মুসলিম সংগঠন কিছু বললো না। মুসলিম নিধন নিয়ে যারা সোচ্চার বা মানবতাবাদীরাও কিছু বলে নি। কেন সব্বাই রাজাকার ইদ্রিসের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে মুখে কুলূপ আটলো তা পরিষ্কার হচ্ছে না। তাই নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে। উকি দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।
একটা কথা হচ্ছে, রাজাকার ইদ্রিস কি মানুষ না? নাকি অন্য কোন গ্রহের প্রাণী! ছাগল গরু মারা গেলেও তো পরিবেশবাদীরা হৈ চৈ করেন। তারাও তো কিছু বলছেন না। দ্বিতীয় কথাটি হলো রাজাকার ইদ্রিস কি মুসলমান না। ইসলামের সোল এজেন্ট জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ বা তাদের দোসররাও তো কিছু বলছে না! কেন? তিনি রাজাকারী করার পরে কী তাহলে আর জামাতি ছিলেন না! নাকি টাকা পয়সা দেন নি বলে মানবাধিকার কর্মীরা মুখে কুলূপ এটেছেন! কোনটা ঠিক?
বিস্তর অভিযোগ আছে যে, জামায়াতের বড়লোক নেতারা ১৯৭১ সালে লুটপাট করে আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা মসজিদ সংস্কারের নামে এনজিও’র মাধ্যমে টাকা এনে অনেক বড়লোক হয়েছে ১৯৭৫ পরবর্তী চার দশকে। তাদের সম্পদ পাহাড়সম বলে কেউ কেউ খবর দিয়েছেন। অভিযোগ আছে যে, এই সব ধনকূবের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দোষী রাজাকারগণ টাকা দিয়ে দেশী বিদেশী লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিলো, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠনকে কিনে নিয়েছিলো তাদের বাঁচানোর জন্য হাউ কাউ করতে দুনিয়া জুড়ে। এখন অনেকেই বলছেন যে, রাজাকার ইদ্রিস ওরফে গাজী ইদ্রিস কাউকে টাকা দেয়নি তাই তার পক্ষে কোন মানবাধিকার সংগঠন বা কর্মী নেই। সবার মুখে তালা। কথাটা ভাবায়, হাসায়, মানবাধিকার ব্যবসায়ীদের চরিত্র কল্পনা করে।
১৯৭১ সালের পরে আমি প্রথম যখন পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন আমকে বলে দেওয়া হয়েছিলো যে, ‘না বলে বা অনুমতি না নিয়ে কখনো পাহাড়িদের ছবি তুলো না, কাউকে দেখে হেসো না। মহা বিপদ হতে পারে’। ওদের সামাজিক সংস্কৃতি ভিন্ন তাই এটাকে ওরা এত সিরিয়াস ভাবে নেয় যে, মহাবিপদ হ’তে পারে। এটা তাদের বিশ্বাসের উপর আঘাত বলেই তার এটা করে। বিশ্বাসের উপর আঘাত এলে অনেকেই অনেক সাংঘাতিক কাজ করতে পারে তাই এভাবে সবাইকে সাবধান করা হয়।
কুখ্যাত অপরাধী বলে আদালত যাদের সাজা দেন তাদের সবার লেবাস কিন্তু একই রকম। মুখে দাঁড়ি। গায়ে পাঞ্জাবী। মাথায় টুপি বা পাগড়ী। হাতে তসবী কারো কারো। দেখে খুব পরহেজগার মানুষ মনে হয়। ১৯৭১ সালেও কিন্তু তাদের এমন লেবাস ছিল। যাকে আমরা ইসলামী লেবাস মনে করি। তাই দাড়ি, টুপি পরা ভালো মানুষদেরকেও অনেকে কুখ্যাত রাজাকার মনে করেন। তাদের নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। কারণ অনেক হলেও লেবাস যে অন্যতম তা অনুমান করতে কঠিন হয় না।
আমাদের এই কালের ছেলে মেয়েরা যারা ১৯৭১ দেখেনি তারা ভাবে যে, দাঁড়ি টুপি মানেই রাজাকার, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দুষ্ট। যারা ধর্মপ্রাণ তাঁরা খুব বিব্রত হন। মানবতাবিরোধীদের লেবাস দেখে অনেকেই বলেন এরা ১৯৭১ সালে এবং তার পরে ইসলামের ক্ষতি করেছে অনেক বেশী। নাস্তিকরা তাদের অবস্থান পরিষ্কার রাখে, আবার পরে পল্টি খেয়ে ধার্মিক হয়, কবি আল মাহমুদ বা ফরহাদ মাজহারের মতো। কিন্তু এরা ধর্মের নামে সব অধর্ম, অন্যায় অনাচার, অপকর্ম করে ইসলামী লেবাস দিয়ে তা জায়েজ করতে চায়। যা ইসলামের জন্য বড়ই ক্ষতিকর।
সাজা পাবার পরে যখন কেউ অপরাধী প্রমানিত হয়, তখন তার আর ধর্মীয় লেবাস পরার অধিকার কি থাকে! আদালত অনেক কিছু নিয়েই স্বপ্রনোদিত হয়ে কাজ করেন। মানবতাবিরোধীদের ইসলামী লেবাস ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনে আঘাত করে, কষ্ট দেয় যা আইনে বারণ। টট আইনে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে বলে অনেকেই মনে করেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বাংলাদেশের আইনে অপরাধ। এটার জন্য অনেকের মন্ত্রিত্ব চলে গেছে। অনেক নামী সম্পাদক হামু দিয়ে মাফ চেয়েছেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য। ব্লগাররা খুন হয়েছে চাপাতির আঘাতে। হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা খুন হয়েছে ইসলাম মানে না বলে। তা হলে সাজা পাওয়ার পরে মানবতাবিরোধীদের ইসলামী লেবাস পরা বন্ধ করবে কে? কে বলবেন, তুমি ভন্ড, তাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পার না ইসলামী লেবাস পরে!
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া শরীয়তপুরের রাজাকার পলাতক ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিস’র যে ছবি পত্রিকায় এসেছে তাতেও তাকে ইসলামী পোশাকে দেখা যায়। আগে যাদের এইসব অপরাধে ফাঁসি হয়েছে তাদের একই লেবাসে দেখেছি আমরা। এর কি কোন প্রতিকার নেই। আমাদের মহামান্য আদালত কি স্বপ্রনোদিত হয়ে কিছু করতে পারেন না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)