প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে গেল ক’মাস ধরে সরগরম ছিলো পুরো দেশ। তাকে নিয়ে শুরু হওয়া এসব আলোচনা-সমালোচনা শেষ, তা নয়। এখনও চলছে, ঢিমেতালে। তবে প্রধান বিচারপতি ইস্যুর স্থলে উঠে এসেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। ‘জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রর্বতক’ মন্তব্য করে এখন তিনি বিরাগভাজন। ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল কোনো নেতা এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত তির্যক মন্তব্য করেনি। তারপরও রাজনীতির মাঠে পরবর্তী ‘ইস্যু’ নূরুল হুদা হতে যাচ্ছেন, তা অনুমেয়। ইতোমধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী হুদা কমিশনের সংলাপ বয়কট করে তার পদত্যাগও দাবি করেছেন।
হুদা কমিশন গঠন প্রাক্কালে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেছিল বিএনপি। তাদের দাবি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা প্রশাসনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকাকালীন দলীয় আচরণ করেছিল। এছাড়া ‘৯৬ সালে ঢাকায় গঠিত জনতার মঞ্চে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়ার ছবি ভাংচুর করেছিলেন। শুধু তাই নয়; গত সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালীর বাউফলে আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে নূরুল হুদা কাজ করেছিলেন বলে দাবি তুলেছিল বিএনপি। ফলে নির্বাচন কমিশন গঠনকালে বিএনপি হুদা প্রশ্নে তীব্র বিরোধীতা করে। বর্তমানে সেই হুদা কমিশনের প্রতি বিএনপি যে আস্থা আনতে শুরু করেছে, ইসি’র সংলাপে যোগ দেয়ায় সেটিই প্রতীয়মান। একইসাথে বিএনপি যে নির্বাচনমুখী, এর মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা হঠাৎ করে বিএনপি এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রশংসা কেন করলেন! এর পিছনে কী এমন কারণ থাকতে পারে, তা অনেককেই ভাবাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ হুদার এমন মন্তব্যকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। দলটির সাধারণ সম্পাদক সিইসি’র বক্তব্যকে কৌশল বলেই মনে করছেন। তার মতে, ‘জিয়াউর রহমানের প্রশংসার বিষয়টি বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কৌশল হতে পারে।’
অপরদিকে ‘জিয়াউর রহমান বহুদলী গণতন্ত্রের প্রবক্তা’ হুদার এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সোমবার (১৭ অক্টোবর) সচিবালয়ে তথ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইসিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ইতিহাস ও রাজনীতি চর্চা করবেন না।’ এছাড়া আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এক প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ‘কম কথা বলার’ পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘কথা বলার জন্য আমরা রাজনীতিবিদরা আছি। কম কথা বলে কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করুন।’
সে যাহোক, আগামী নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা যে কে এম নূরুল হুদা চালাচ্ছেন, সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই। সংলাপের আয়োজন এবং এতে প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি অত্যন্ত ইতিবাচক। এতে করে অনুমান করা যায়, আগামী নির্বাচনে তিনি সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। তবে এ জন্য বিএনপি ইসিতে যে ‘২০ দফা’ দাবি উত্থাপন করেছে, তার কিছুটা হলেও বাস্তাবায়ন করতে হবে। আর সেটি সম্ভব না হলে, এই সংলাপ ফলপ্রসূ হবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে। বিশেষ করে তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেয়া, সহায়ক সরকারের অধিনে নির্বাচন এবং বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা বাহিনী নামানোর যে দাবি বিএনপি করেছে, তা মানা না হলে শেষতক তাদের নির্বাচনে আনা সম্ভব হবে কিনা, এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বহু আগে থেকেই তত্বাবধায়ক সরকার অধিনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। সে দাবি মেনে না নেয়াই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বয়কট করে। তবে বিএনপি তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে এবার সরে এসে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’ ব্যবস্থার দাবিতে এসে ঠেকেছে। এতে করে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি কিছুটা হলেও নমনীয় হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ এখনও আগের অবস্থানেই রয়েছে গেছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই এবং প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই একাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এ কথাই দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করছে।
সর্বশেষ ইসি’র সাথে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করেই জানিয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর সেটি হবে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। একইসাথে সেনা মোতায়েন ‘না করার’ পক্ষে ইসির কাছে দেয়া ১১ দফায় উল্লেখ করেছে। তাই প্রশ্ন ওঠেছে, শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের অধীনেই যদি আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি কী নির্বাচনে আসবে নাকি বর্জন করবে? একাদশ নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনে বিএনপির আসা না আসাটা এখন সব থেকে বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অতীত এবং বর্তমান মিলিয়ে আওয়ামী লীগের মনোভাব এখনও পর্যন্ত একই বিন্দুতে। ফলে বিএনপি নির্বাচনে আসুক আর না আসুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। দলটি শুরু থেকে নির্বাচন প্রসঙ্গে এমন বক্তব্যই দিয়ে আসছে। সুতরাং অনুমান করে বলা যায়, সামনে তাদের মত পাল্টাবে না! যদি তাই হয়, তবে কী আবারও ৫ জানুয়ারির মতো আরও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? রাজনৈতিক সংঘাত সংঘর্ষ কী ফের অনিবার্য? এমন ভাবনা সাধারণ মানুষকে বেশ ভালো করেই ভাবাচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশেনর জন্য কুমিল্লা সিটি কর্পেোরেশন নির্বাচন ছিল ‘অ্যাসিড টেস্ট’। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই প্রত্যাশা করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামীতেও নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। অবশ্য বর্তমান নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই বলে আসছে, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চায় তারা। এবং তা হবে অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সার্বজনীন। তবে মূল কথা হচ্ছে, নির্বাচন যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, তা অবশ্যই সর্বমহল গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ নিয়ে কোনো মহল যেন কোনো রকম প্রশ্ন তুলতে না পারে। কোনো অভিযোগ যেন কেউ উত্থাপন করতে না পারে। এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করা জরুরী।
তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানতম লক্ষ্যই থাকে নির্বাচনে জয়লাভ করা, সেটা যেভাবেই হোক বা যেকোনো মূল্যে। এ কারণেই সংঘাত-সংঘর্ষ আর আস্থাহীনতার জায়গাটা প্রকট হয়ে ওঠে। এ অবস্থা গত কয়েক দশক ধরে দেখে আসছি। এ ধারার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। তা না হলে গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহতই হবে। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে হবে নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে। রাজনীতি যেহেতু দেশ ও জনকল্যাণে তাই প্রতশ্যা করবো, দেশ-জনতার স্বার্থে সংঘাত ও সংঘর্ষের পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখবে রাজনৈতিক দলগুলো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)