ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিলের রায় নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বন্দ্বে প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক পদটি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক চলছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে অসুস্থতার অজুহাতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহাকে ছুটি নিতে হয়েছে। ছুটি নিয়ে দেশের বাইরেও গেছেন। যাওয়ার আগে তার এক চিঠি এবং পরের দিন সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন এক চিঠির কারণে ছুটি শেষে এখন তিনি স্বপদে ফিরতে পারবেন কি না এনিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এমন প্রশ্নের একটা জবাব অবশ্য ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। জানিয়েছেন, ‘অভিযোগের সুরাহা না হলে চেয়ারে বসতে পারবেন না প্রধান বিচারপতি’। অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির স্বপদে ফেরা সুদূর পরাহত’। ফলে ধারণা করা যায়, প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে একটা নির্দিষ্ট ছক ধরে এগোচ্ছে সরকার। এ ছক যদি শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয় তবে প্রধান বিচারপতি হয়ত স্বাভাবিক অবসরে যেতে পারছেন না। এটা কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? একি ছিল তার যোগ্য প্রতিদান? প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রধান বিচারপতি স্বাভাবিক অবসরে যেতে না পারার আশঙ্কা এবং তার স্বপদে না ফেরার বিষয়টি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এ আলোচনার পুরোটাই রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে; সরকারপক্ষ প্রধান বিচারপতির বিপক্ষে আবার সরকার বিরোধী ও দলনিরপেক্ষ পক্ষ প্রধান বিচারপতির স্বপদে ফেরার পক্ষে। এটা হয়ত নির্ধারিত হতো এসকে সিনহার অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফেরার পর, কিন্তু এই মুহূর্তে সবকিছু উল্টে গেছে আদতে সুপ্রিম কোর্টের বিরল ও নজিরবিহীন এক বিবৃতির পর, যেখানে বলা হয়েছে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে কাজ করতে আগ্রহী নন। ওই ৫ বিচারপতির অভিযোগ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিচারপতিদের হাতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ দিয়েছেন। এমন অভিযোগের খবর জেনে বিচারপতিগণ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে অভিযোগের সুরাহা না হলে তারা এক সঙ্গে কাজ করবেন না বলে জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের কাছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগের যে দালিলিক প্রমাণ দিয়েছেন সেগুলো নিশ্চিতভাবেই সরকারি কোন এজেন্সি মাধ্যম প্রাপ্ত, এবং তদন্ত-পূর্ব অভিযোগ নিশ্চিতভাবেই। কারণ রোববার আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন অভিযোগের তদন্ত হবে, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছেন তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফলে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়, ১১টি অভিযোগ নামে যা কিছু রাষ্ট্রপতির হাত থেকে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কাছে গেছে সে বিষয়ে তদন্ত হয়নি, স্রেফ অভিযোগ পর্যায়ের এটা অন্তত বর্তমান ও সাবেক আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। রাষ্ট্রপতি সেক্ষেত্রে তদন্ত ছাড়াই আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কাছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ দিয়ে পুরো বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে ফেলে দিলেন কি না- এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত শুনতে আগ্রহ বাড়ছে। এরপর প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিরল এক বিবৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কি তবে প্রচারিত এই অভিযোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দিল?
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে আসা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার, নৈতিক স্খলন সহ ১১ অভিযোগ নাকি এসকে সিনহার প্রধান বিচারপতি পদে সমাসীন হওয়ার আগের, মানে পদে আসীন হওয়ার পর থেকে কোন অভিযোগ ওঠেনি। তাহলে এ অভিযোগগুলো রাষ্ট্রপতির কাছে কখন গেল? প্রধান বিচারপতি পদে তার নিযুক্তির আগে কি যাচাই-বাছাই ও খোঁজখবর নেয়া হয়নি? নেয়া হলে তখন এ দায়িত্বে যুক্তদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা কি ছিল না?
রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের কাছে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর দালিলিক প্রমাণ হস্তান্তর করেছেন সেপ্টেম্বর মাসে; প্রধান বিচারপতি ছুটির আবেদন করেছেন ২ অক্টোবর, ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে গেছেন, ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া গেছেন আর ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে এমন আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের অভিযোগ পাওয়ার কথা। মাঝখানে এত সময়ক্ষেপণ তবে কেন হলো? ছুটি কাটাতে দেশের বাইরে যাওয়ার পর কেন তবে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল জানাচ্ছেন প্রধান বিচারপতির স্বপদে ফিরতে না পারার কথা? এগুলোর মধ্যে কি রাজনীতি জড়িয়ে পড়েনি?
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অভিযোগ, অনুযোগ ও বিরোধীতা। যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিলের রায় নিয়ে। ওই রায়ে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছিল। সংবিধানের ওই সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আপিলেও ওই বাতিলের রায় বহাল থাকে। রায়ের পর প্রধান বিচারপতি একদফা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা ও বাক-আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, আর দ্বিতীয় দফা শিকার হয়েছিলেন রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ কথাগুলো নিয়ে। রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়ন করেছেন এমন অভিযোগ করেছিল আওয়ামী লীগ, কিন্তু ১ আগস্ট রায় প্রকাশের পর প্রায় তিন মাসেও সরকারি দল অবমূল্যায়ন কোথায় হয়েছে এনিয়ে রায়ের একটা অনুচ্ছেদও দেখাতে পারেনি।
তবে এরই মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতা, সরকারপন্থী আইনজীবী নেতারা অশিষ্ট সম্বোধনে অনেক বাক-আক্রমণ করেছেন। মন্ত্রী থেকে শুরু করে আপিল বিভাগের অবসরে যাওয়া একজন বিচারপতিও বলেছিলেন প্রধান বিচারপতিকে পদ ছাড়তে হবে, দেশও ছাড়তে হবে। তাদের ওই সময়কার বক্তব্যগুলো মেঠো বক্তৃতা মনে হলেও এরমধ্যে কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল বলে তাৎক্ষণিক মনে না হলেও দীর্ঘ ছুটি, দেশের বাইরে যাওয়া আর ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বিচারপতিদের হাতে আসার পর তাদের একই বেঞ্চে বিচারকের আসনে বসতে অনীহার কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিরল বিবৃতি এসব ঘটনার দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ছুটি শেষে স্বপদে ফিরে আগামি বছরের ৩১ জানুয়ারি স্বাভাবিক অবসরে যেতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। ছুটি শেষে কি দেশ ফিরবেন, ফিরে কি ফের ছুটি নেবেন? আর মাত্র তিন মাস আছে তার অবসরে যাওয়ার, এই ছুটি-ছুটি পর্যায় চলতে থাকলে অথবা দেশে না ফিরলে অথবা ফিরতে না পারলে স্বাভাবিক অবসরে যাওয়া সম্ভব হবে না। অথচ এটা তার প্রাপ্য ছিল।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখা, আদালতে আইনি বিষয়ে অ্যার্টনি জেনারেলকে নাস্তানাবুদ করা, বিভিন্ন ইস্যুতে তার বক্তব্য, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন, দুই মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার রায়ে শাস্তি দেওয়া এবং আদালতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদাহরণ প্রসঙ্গক্রমে আনা যদি সরকারের দৃষ্টিতে তার অপরাধ হয়ে থাকে তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও বিভিন্ন রায়ে মূল্যায়নের বিষয়টি আড়ালে পড়ে যায়।
তিনি হচ্ছেন সেই বিচারপতি যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারপতি হিসেবে শপথ নিতে নিজের চিকিৎসার মাঝ পর্যায়ে দেশে এসে শপথ নিয়ে ফিরেছিলেন চিকিৎসায়। অনেকের হয়ত মনে আছে, ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় শুনানি করতে একের পর এক বিচারপতি ‘বিব্রত’ হয়েছিলেন; অবস্থাটা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল হাইকোর্টে বিচারপতির অভাবে মামলার কার্যক্রম ছিল অনেকটাই স্থবির। এস কে সিনহা সেই পর্যায় থেকে মামলাকে উদ্ধার করেছিলেন, দেশের বাইরে নিজের চিকিৎসা স্থগিত রেখে ফিরে এসে শপথ নিয়েছিলেন। এটাকে কেবল দায়িত্ব-পর্যায়ের মধ্যে ফেলে রাখলে তার সে অবদানকে অবমূল্যায়ন করা হয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যাসত্য নিয়ে কোন মন্তব্য করব না, কারণ এটা তদন্তসাপেক্ষ। তবে সরকারের সঙ্গে বিরোধ ও সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের বাক-আক্রমণ ও তাকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হবে না বলে হুমকির পর আনিত অভিযোগ কিন্তু সকল অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলক কি না এনিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়। হতে পারে অভিযোগগুলো সত্য, কিন্তু কাউকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হবে না, দেশ ছাড়তে হবে- এমন হুমকির পর সে অভিযোগগুলোকে হালকা করে দিয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে।
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা কার- এনিয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। সংসদের হাতে সে ক্ষমতা বাতিলের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি ফিরে এসেছে- এ নিয়ে নানা মত থাকলেও সরকার এ কাউন্সিলকে স্বীকার করছে না। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) করবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। এক্ষেত্রে সামনে হয়ত প্রশ্ন আসবে সাংবিধানিক পদে থাকা একজন সিটিং চিফ জাস্টিসের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষমতা দুদকের রয়েছে কি না। হুট করে সৃষ্ট মতবিরোধ, অভিযোগ, অভিমান- যাই থাকুক না কেন তাকে প্রতিপক্ষ ভেবে শায়েস্তা করতে গিয়ে সাংবিধানিক পদকে যাতে অবমূল্যায়ন করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। দুদক কি এখন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে- এমন প্রশ্ন করা হলে আসবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাই সরকারের নিজেদের স্বার্থে বিতর্কিত এ প্রক্রিয়ার ইতি টানা জরুরি।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা আর মাত্র তিন মাস পর। এই সময়ে সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে তাকে যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অবসরে যেতে দেওয়া না হয় তবে সেটা ভালো উদাহরণ হবে না। এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক হওয়া জরুরি। সরকারের কাছে ইতিবাচক সে সিদ্ধান্ত আশা করতেই পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)