চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর কী করতে পারতেন?

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত, নির্যাতিত রোহিঙ্গার কী অবস্থা তা নতুন করে বলা অনর্থকই। গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা মানুষগুলো কতটা অমানবিক জীবনযাপন করছেন। কতটা কষ্ট করে তারা বেঁচে আছেন। জীবন কতটা সংকটময় এবং দূরহ তা কেবল এখন তারাই বুঝতে পারছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, আক্রমণ আর অত্যাচারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পাহাড়ে, ঝোঁপজঙ্গলে, রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরেই তারা আসছেন আর আসছেন। না এসেও তাদের কিছুই করার নেই। শ্রেফ জীবন বাঁচানোর জন্যই কেবল নিজ জন্মভূমির ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে তারা বাধ্য হয়েছেন।

রোহিঙ্গারা বলেছেন, নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে তাদের ঘরবাড়ি ছিল। জমি-জিরেত, গরু-বাছুর, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচারণ এবং কঠোর ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মধ্যেও খেয়ে পরে তারা ভালোই ছিলেন। কিন্তু এখন তারা সর্বশান্ত। সব ফেলে শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য তাদের আপন আবাস ছেড়ে আসতে হয়েছে। তাদের আসাটাও বড্ড করুণ এবং কষ্টকর। সাত থেকে দশদিন পায়ে হেঁটে এরপর উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে ঠাঁই নিতে হয়েছে। দিনের পর দিন তাদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে। যারা এসেছেন তাদের পরিবারের অনেকেই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, কেউ হারিয়েছেন স্বামী, স্ত্রী, সন্তান। বলা হচ্ছে ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। অনেককেই গুলি করে, পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। একইসঙ্গে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণেরও শিকার হয়েছেন।

মিয়ানমার-রোহিঙ্গাশরণার্থী হয়ে জীবন নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন তার মধ্যে কয়েক লক্ষ নারী এবং শিশু এখন সবচেয়ে করুণ অবস্থার মধ্যে পতিত। গত তিন সপ্তাহে নতুন করে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেছে চার লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা। এই চার লাখের মধ্যে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে। এই শিশুদের বড় অংশের মা-বাবা নেই। প্রতিবেশী বা অপরিচিতজনের হাত ধরে তারা বাংলাদেশে এসেছে। এই শিশুরা এখন সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউনিসিফের শিশু সুরক্ষা প্রধান জ্যঁ লিবে বলেছেন রোহিঙ্গা শিশুরা অবিশ্বাস্য স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ক্ষুধা আর দীর্ঘপথ হেঁটে হেঁটে তারা ক্লান্ত। এ ছাড়া অনেকেই নিজের সামনে বাবা-মায়ের মৃত্যু দেখে ভীতসন্ত্রস্ততা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শরণার্থী হয়ে জীবন নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন তার মধ্যে কয়েক হাজার সন্তান সম্ভাবা মাও রয়েছেন।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। বিভিন্ন দেশে থেকে জরুরি সহায়তা হিসেবে ত্রাণ আসছে। সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে গেছেন উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের কাছে।

ফরিদুপরের উন্নয়নকর্মী, উন্নয়ন সংগঠন বিএফএফ-এর নির্বাহী পরিচালক আনম ফজলুল হাদী সাব্বির, তিনিও কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মাঝে একেবারেই নিজেদের উদ্যোগে এবং সাধ্যমত ত্রাণ দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। তাদের টিমে আরও ছিলেন ফেডারেশন অফ এনজিওস ইন বাংলাদেশ, ফরিদপুর জেলা শাখার সভাপতি, এফডিএ-এর নির্বাহী পরিচালক মো. আজহারুল ইসলাম, এসডিএস-এর নির্বাহী পরিচালক কাজী আশরাফুল হাসানসহ অন্যান্যরা। উখিয়ার ঘুমধুম বর্ডারে তারা গিয়েছিলেন বিষয়টি স্বচক্ষে দেখার জন্য। আনম ফজলুল হাদী সাব্বির জানিয়েছেন, যাওয়ার আগে তিনি নিজেও কল্পনা করেননি রোহিঙ্গাদের দুরাবস্থার কথা। বাঁচার জন্য ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধার্ত হাজার হাজার শিশুর দীর্ঘপথ হেঁটে আসা দেখে তিনি নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তিনি নিজেও নিজদেশে দাঁড়িয়ে ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে টহল সেনা বাহিনীর তৎপরতা দেখেছেন।

রোহিঙ্গাদের জন্যে যতটুকু ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন তা বিতরণ করেছেন শিবিরগুলোর আশেপাশে। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। মিডিয়াতেও অনেক নেতিবাচক রিপোর্ট এসেছে। সাব্বিরের মতে, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা তিনিও স্বচক্ষে দেখেছেন। তবে মূল ক্যাম্পে নয়, মূলত রাস্তার আশেপাশে যেখানে শরণার্থীরা দাঁড়িয়ে আছে ওখানেই ত্রাণ বিতরণে সবচেয়ে অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। এবং যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়েছেন তারা কোনো সমন্বয় না করার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হচ্ছে বলে তিনি জানান।

সন্দেহ নেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। সঠিক সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। তবে গোটা পরিস্থিতি ঘোলা করার জন্য ভেতরে ভেতরে নানান গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এমনটি আঁচ করা যায়। এ কারণে এরকম অনুমান করা অন্যায় হবে না যে কোনো চক্র সুযোগ পেলেই বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে যা সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করতে পারে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতে এ ধরণের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষীমহল নানা ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অনেকেই পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছেন। উগ্রবাদীদের অনেকেই দেশের বৌদ্ধ পাড়া-মহল্লায় হামলার হুমকিও প্রদান করছে। সম্প্রতি অনেকেই রাম দা, লাঠি হাতে নিয়ে বৌদ্ধদের উপর হামলা চালানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে নিজেদের করা ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে বিষয়টি বেশি বেশি করে শেয়ার করার আহ্বান জানাচ্ছে। কুচক্রীরা এসব ভিডিও আবার নিজেরাই বিভিন্ন জনের ইনবক্সে শেয়ার করছে।

একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একদল তরুণ রামদা আর লাঠি হাতে নিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার মহড়া দিচ্ছে। তারা এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা সরকারি দলেরই সমর্থক। বারবার প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর কথা বলছে। বুঝা যাচ্ছে এসবই পরকল্পিতভাবে স্যাবোটাজ করার জন্য করছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উচিত এসবের প্রতি নজরদারি বাড়ানো এবং উস্কানিদাতাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা। ফেসবুকে এধরনের উস্কানিমূলক ভিডিও ছাড়া হলে বা শেয়ার করা হলে সেগুলো দ্রুত বন্ধ করার কৌশলও প্রয়োগ করতে হবে।

এদিকে ইসলামী দলগুলোও বিভিন্ন মসজিদেও সামনে জড়ো হয়ে নানারকম উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের একটি অংশও আবার অকারণে অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে ফেসবুকে একধরণের উস্কানি ছড়িয়ে চলেছে। আশার কথা যে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও তেমন কিছু ঘটেনি। তবে না ঘটলেও সরকারের পক্ষ থেকে খুবই সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে নিজের এবং রাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সর্বশেষ জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ে সভায় যোগ দিতে গিয়েও তিনি সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে ফের বলেছেন, ‘যদি আমরা ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারি তাহলে আরও ৫ অথবা ৭ লাখ লোককেও খাওয়াতে পারবো।’ অনুমিত হচ্ছে কাউকে সেভাবে পাশে না পেলে মানবিক কারণেই তিনি কাউকে অভুক্ত রাখবেন না। তাড়িয়ে দেবেন না।

এটি সত্য মিয়ানমারের নিষ্ঠুর সামরিক জান্তা রাখাইনে যে নির্মম অবস্থা তৈরি করেছে তাতে করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিলনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর আজকে যারা উহ আহ করে নানা প্রশ্ন করছে তারাই আবার নানা সমালোচনা দুয়ার খুলে বসতো। এটিকে অনেকেই মুসলিম ইস্যু বলে জাহির করে ধর্মীয় রঙ দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের একশ্রেণীর এলিটরাও এটাকে আবার অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে।

তবে এটি সত্য পুরো বিষয়টিই এখন বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সামনের দিনগুলো এবং বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথ যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে করে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে নিয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে হবে। তবে সবার আগে এই উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে কোনো ঘাপটি মারা চক্র ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সুকৌশলে রোহিঙ্গাদের সমাজবিরোধী কাজ কর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারে। এখানে প্রশাসনযন্ত্রকে খুবই শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এই মুহূর্তে সরকারের উচিত হবে প্রশাসনযন্ত্রের সবচেয়ে দক্ষ মানুষগুলোকে কাজে লাগিয়ে গোটা ব্যবস্থাপনায় সঠিক জবাবদিহিতা তৈরি করা। যাতে কোনো ধরনের অঘটন যেন না ঘটতে পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)