চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রধানমন্ত্রী কী নেত্রকোনার হাওরে আসবেন

হাওর পাড়ে ব্যাংক ও এনজিওগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি নির্দেশনার অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। ধনকুবেররা কোটি কোটি টাকা লোন নেয় তাদের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করে না, অথচ অস্বচ্ছল কৃষক ৫, ১০হাজার টাকা লোন নিয়ে মামলার আসামী হয়। কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান লোকসান দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করিয়ে নেয়। আর কৃষক ঋণের টাকায় গরু কিনে, সেই গরু মারা গেলে মামলার আসামী হয়। ব্যাংকের কত টাকা রিজার্ভ চুরি হয়েছে? আরও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যত টাকা লোপাট হয়েছে তা কি হাওরবাসীদের ঋণের থেকে বেশি? যারা গরিবের রিলিফ মেরে খায়, সরকারি বরাদ্দ মেরে খায় তাদের কি বিচার হয় এদেশে?

বলা হচ্ছে এনজিওর কিস্তি স্থগিত, কৃষকদের ব্যাংক ঋণের কিস্তি স্থগিত, বিদ্যুত বিল স্থগিত। এই স্থগিত ঘোষণায় কী উপকার হবে মানুষের। স্থগিত হওয়া এসব কিস্তি পরিশোধে যখন একসাথে তাগাদা আসবে তখন কী হাল হবে কৃষকের?

সরকার হাওরবাসীকে ত্রাণ হিসেবে চাল আটা দিচ্ছে। আবার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ‘কিসের দুর্যোগ’ বলে হাওরবাসীকে কটাক্ষ করছে।  সরকার চাল, আটা ও নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে এসব বরাদ্দ কি কৃষকদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবে? কোন বরাদ্দটা মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মিটাতে পেরেছে? সরকার ভিজিএফ চাল দেয়, ভিজিডি দেয়, বয়স্কভাতা দেয়, বিধবা ভাতা দেয় ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়। এসব ভাতা যারা নেয় তারা অন্য কোন কাজ না করলে এসবের উপর ভিত্তি করে বাঁচতে পারবে? যদি কেউ এমন ইচ্ছে করে তাহলে কি সে না খেয়ে মরবে না? সরকার কর্তৃক প্রদত্ত চাল ও আর্থিক অনুদান নির্ভর হয়ে যদি কেউ বেঁচে থাকতে চায় সেটা কি অবাস্তব ভাবনা হবে না?

মানুষের ফসল ডুবেছে, হাওরের মাছ মরেছে। হাঁসখামারিদের হাঁস মরেছে। কৃষকের প্রত্যাশা ছিল ফসল কেটে মহাজন, এনজিও ও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে।এখন ফসল নেই, হাঁস নেই, মাছ নেই ঋণ পরিশোধতো দূরের কথা খাবে কী। আশা ছিল ধারদেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল গচ্ছিত রেখে পরিবারের খাদ্য চাহিদা মিটাবে। শতশত হাওরবাসী উদ্বাস্তু হয়ে শহরে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে।

মদন উপজেলার তল্লার হাওর পাড়ে একটি গ্রাম দেওসহিলা। এই হাওরটির অবস্থান নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের দুই জেলা মিলিয়ে। কৃষক মিষ্টার মিয়া (৪৫) চাল জুটাতে না পেরে ৬দিন আলু খেয়ে বেঁচেছে। সংবাদ পত্রে শিরোনাম হয়েছে, সরকারী চাল পেয়ে ৬দিন পর ভাত খেলেন মিষ্টার মিয়া। ইটনা উপজেলার আরাইল্লা গ্রামের একজন, মদন উপজেলার রুদ্রশ্রী গ্রামের একজন ও মাঘান ইউনিয়নের একজন কৃষক ফসলডুবি দেখে স্ট্রোক করে মারা যায় বলে হাওরবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেল।

স্বচ্ছল, অস্বচ্ছল নির্বিশেষে সকল কৃষকই দুর্দশাগ্রস্থ। তল্লার হাওরপাড়ের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ১৩ আরা জমি (১০ শতকে ১ কাঠা ও ১৬ কাঠায় ১ আরা) জলে ডুবেছে। কিভাবে বাৎসরিক কাজের লোকের বেতন দেব ও পরিবার নিয়ে চলবো? সেটাই ভাবছি।

কলেজ ছাত্র কাকন বলেন, আমাদের সবকিছু ডুবে গেছে কিভাবে আমার পড়ার খরচ ও সংসার চলবে? তল্লার হাওরে কোন ফসল রক্ষা বাঁধ নেই। আমাদের একমাত্র দাবি একটি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে দেয়া হোক। এলাকাবাসীর সাথে আরও কথা বলে জানা গেল, বাঁধের জন্য ৫লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছিল কিন্তু এর কোন সুফল তারা দেখেনি।

নেত্রকোনায় জনতা দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রীর হাওরপাড়ে না যাওয়ায় মানববন্ধন করেছে। হাওর ডুবেছে মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুরিতে আর মন্ত্রী গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করলেন বারহাট্টায়। এনিয়েও জনমনে প্রশ্ন। তিনি এনজিও ঋণ স্থগিত, বিদ্যুত বিল স্থগিত ও ব্যাংক ঋণ স্থগিত বলে চলে গেলেন। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে হাওরপাড়ে? এনজিওরা বিভিন্ন গ্রামে কিস্তি আদায় করে চলেছে। এনজিও, পল্লী বিদ্যুত, ব্যাংক কর্তৃপক্ষও স্থগিতের ব্যাপারে কোন ঘোষণা দেয়নি। জনমনে প্রশ্ন এই স্থগিতের ঘোষণাও কি শুধু বক্তৃতা পর্যন্তই থাকবে? আরও রয়েছে এই ঘোষণা প্রয়োগের অঞ্চলগত অস্পষ্টতা। এটি কি উপজেলা ভিত্তিক নাকি কোন কোন গ্রামভিত্তিক? গ্রামভিত্তিক হলেও কোন কোন গ্রামগুলো স্থগিতের আওতায় তাও পরিষ্কার করা হয়নি।

এনজিওরা হাওরপাড়ের দুর্দশা ও দারিদ্রতা দেখিয়ে বিদেশ হতে কোটি কোটি ডলার নিয়ে আসে। অনুন্নত এলাকার দুর্দশাই তাদের পুঁজি। কিন্তু যেদেশের গরিব মানুষদের দেখিয়ে তারা এই প্রতিষ্ঠান গড়েন সেই গরিবদের কোন খবর নেন না তারা। একটি আমেরিকান সংস্থা হাওর এলাকায় কাজ করার জন্য শতশত কোটি টাকা বরাদ্দ এনে সিংহভাগ নিজেদের বেতন হিসেবে রেখে বাকি অংশ মাইক্রোক্রেডিট বিভিন্ন এনজিওকে দিয়ে দেয়। হাওরবাসীর এই দুর্দশার দিনে আজ তারা কোথায়?

এনজিওদের কিস্তির ভয়ে অনেকেই এলাকা ছাড়ছে। এছাড়া আরো আছে কাবুলিওয়ালার ফটোকপি সুূদখোর মহাজনদের দৌরাত্ম। ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে জাতীয় একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল: ‘পালিয়েছে সেই মহাজনরা, পুলিশের অভিযানে আটক ২’। প্রতিবেদনটিতে লেখা ছিল: বাগেরহাটের চিতলমারির সুদে মহাজনদের বিরুদ্ধে অবশেষে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। এপর্যন্ত ২ জন গ্রেফতার হয়েছে। এই অবৈধ সুদ বাণিজ্য নিয়ে খবর ছাপা হওয়ার পর প্রশাসনের টনক নড়েছে। গ্রেফতার এড়াতে মহাজনদের অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছেনা বলে দাবি করেছে। প্রতিটি হাওর এলাকাতেই রয়েছে এমন সুদখোর মহাজনদের দৌরাত্ম। একশ্রেণীর মানুষ সুদকেই নিজেদের পেশা হিসাবে নিয়ে থাকে। সুদের উপর টাকা নিয়ে কিস্তি না দিলে ঘরের টিন খুলে নেয়, জমি লিখে নেয়। সুদের হারেরও কোন সীমানা নেই। যে যার ইচ্ছেমত সুদের হার দিয়ে থাকে। এই মহাজনদের ভয়েও অনেকে এলাকা ছাড়ছে বলে জানা যায়।

মানুষের অন্যতম ভরসা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের বরাদ্দগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হলে মানুষের এতটা দুর্ভোগ হতো না। তিনি হাওর পরিদর্শনে আসছেন জেনে হাওরবাসী আশান্বিত। হাওরের মানুষ হিসাবে আপনাকে স্বাগতম জানাই। সেই সাথে অনুরোধ জানাই নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুরী উপজেলার হাওরগুলো দেখে যান। দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী না দেখায় মানুষ দুঃখ পেয়েছে। দুঃখ পেয়ে তারা মানববন্ধন করেছে। আপনি এলে সে দুঃখ লাঘব হবে।

মোহনগঞ্জের চরহাইজদা বাঁধ প্রতিবছরই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। খালিয়াজুরিতে চলছে হাহাকার। মদনের তল্লার হাওরে নেই ফসল রক্ষা বাঁধ। হাওরের মানুষ আপনাতেই নির্ভরতা খোঁজে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)