চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: ব্যবসায়ীদের চাওয়া শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার

স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে থাকে ভারতের সঙ্গে। তবে এই হার রপ্তানিতে নয়, বলতে গেলে পুরোটাই আমদানিতে।

বিভিন্ন শুল্ক-অশুল্ক বাধার কারণে চার দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে যথসামান্য।বিপরীতে আমদানি বেড়েছে প্রায় কয়েকগুণ। গত ১৪ বছরেই বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ব্যবসায়ীদের প্রধান দাবি হবে এসব বাধা দূর করা।

বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৮৯ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বিপরীতে ৫৪৫০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। অর্থাৎ ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪৭৬১ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০০১-২০০২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫০ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। আর আমদানির পরিমাণ ছিল ১০১৮ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার।

সে হিসেবে গত ১৪ বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৬৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু একই সময়ে ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ৪৪৩১ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমদানি বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণ।

বাংলাদেশের সাথে কখনই ভারতের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না বলে মনে করেন ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি তাসকিন আহমেদ।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশে অধিক পরিমাণে পোশাক উৎপাদন হয় ঠিক। কিন্তু এর অধিকাংশ কাঁচামালই (যেমন তুলা) আনতে হয় ভারত থেকে। তবে এই ঘাটতি কমিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য।

শুল্ক বাধা প্রসঙ্গে তাসকিন আহমেদ বলেন, ‘ভারতের বিধানসভা বলে আসছে, বাংলাদেশের ২০ থেকে ২২ টি পণ্যে শুল্ক ফ্রি। কিন্তু আসলে তা বাস্তবায়ন হয় না। কারণ বিধানসভা মানলেও রাজ্যসভা তা মানে না। ফলে কোনো প্রদেশে রপ্তানিতে শুল্ক ফ্রি, আবার কোনোটিতে শুল্ক দিতে হয়। এ কারণে ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাধা পুরোপুরি দূর হয়নি আদৌ। এছাড়া অশুল্ক বাধা তো আছেই। তাই সফরে শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করতে আমরা জোর দাবি তুলবো’।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে ভারতই বেশি লাভবান হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ আছে। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র হওয়ায় সহজে তারা কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারবে। তাই তৈরি পোশাক, প্রকৌশল খাত, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করতে তাদের আহ্বান জানাবো।

এছাড়া সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে যে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক (বাজার দখলে কম দামে পণ্য ছাড়ার শাস্তিস্বরূপ শুল্ক) আরোপ করেছে। এ প্রক্রিয়া যেন বন্ধ করা হয় সে বিষয়েও দাবি তোলা হবে বলে জানান ভারত-বাংলাদেশ ব্যবসায়ীদের এ সভাপতি।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এই সফর ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ।

ভারত সফরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কি থাকবে জানতে চাইলে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘এ সফরে বাংলাদেশের বড় বড় ২০ থেকে ৩০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নিবে। সেখানে বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) আলোচনা হবে। বিশেষ করে পাওয়ার সেক্টর, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), টেক্সটাইল, টুরিজম, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, ট্রান্সমিশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে’।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন অবকাঠামো দুর্বলতা, শুল্ক-অশুল্ক বাধা ও বন্দরসংক্রান্ত সুবিধাসমূহ, এবং ঝামেলাপূর্ণ রপ্তানি-প্রক্রিয়া। তবে দুই দেশ উদ্যোগ নিলে এসব বাধা দূর করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অশুল্ক বাধা (যেমন নিবন্ধন ফি, ল্যাব ফি)। এসব কারণে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারে না। বার বার বলা হলেও এসব বাধা এখনও রয়ে গেছে।

এছাড়া বিনিয়োগ নিয়েও সমস্যা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করার কথা বললেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হয় না। ভারত ই-কমার্সে অনেক এগিয়ে। তারা চাইলে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে যৌথবিনিয়োগ করতে পারে। এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব দিতে হবে।

বাংলাদেশের অদূরে ভারতের যেসব রাজ্য রয়েছে সেগুলোতে কিছু পণ্য প্রবেশ করে। তবে অন্যান্য প্রদেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুযোগ বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো দৃঢ় করার উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ভারতে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এসব সমস্যা সমাধানে করণীয় নির্ধারণ এবং পর্যালোচনা করা হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে ভারতীয় বিনিয়োগ।