চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি: লটারি না পরীক্ষা

সারাদেশের স্কুলগুলোতে আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতি চালু রেখে নীতিমালা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত কয়েক বছর যাবত এভাবেই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হচ্ছে শিশুদের। কিন্তু এ পদ্ধতিতে ভর্তি নিয়ে বিভিন্ন মত এসেছে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ এবং মনস্তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে।

শিক্ষকেরা বলছেন, লটারির মাধ্যমে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম যাচাই করার সুযোগ থাকছে না। তাই মানহীন শিক্ষার্থী ভর্তি করার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানও পড়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা মনে করছেন, লটারির ফলে অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে শিশুরা; বন্ধ হচ্ছে ভর্তিবাণিজ্যও। মনোবিদরা বলছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি থাকতে পারে; তবে তা কিছুতেই যেন শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ না তৈরি করে। আর শিক্ষাবিদরা বলছেন, লটারি বা ভর্তি পরীক্ষা কোনটিই সমাধান নয়।

রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শাখার সিনিয়র সহকারী শিক্ষিকা জহুরা বেগম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ন্যূনতম হলেও একটা পরীক্ষা থাকা দরকার। কারণ আমরাতো কঠিন পরীক্ষা নেইনা, শুধু বেসিকটা দেখি। কিন্তু লটারির ফলে সে সুযোগটাও থাকছে না। তাই মানহীন শিক্ষার্থী ভর্তির ফলে নেমে যাচ্ছে ভালো স্কুলগুলোর মানও।

‘‘হাতের পাঁচটা আঙুল কখনও সমান হয় না। তেমনি আমাদের শিশুদেরও মেধা সমান হয়। যদি আপনি সারাদেশে একই মান নিশ্চিত করতে পারতেন তবে লটারি পদ্ধতি ভালো ছিল। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে বা শহুরে শিশুদের মানতো এক নয়। তাই ন্যূনতম যাচাইয়ের সুযোগ থাকা উচিত’’ বলেন ২৮ বছর যাবত শিক্ষকতায় থাকা জহুরা বেগম।

তবে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তির পক্ষেই মত অধিকাংশ অভিভাবকের।

আতিকুর রহমান দর্জি নামক এক অভিভাবক ফেসবুকে লিখেছেন: এখন লটারির ফলে ভর্তি সিন্ডিকেট ভেঙ্গে গেছে, কোচিং বানিজ্য ভেস্তে গেছে আর বেছে বেছে  নিজেদের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর সুযোগও নাই! জীবনের শুরুতে পরীক্ষা বানিজ্যের কবল থেকে মুক্তি পেলো ছোট ছোট বাচ্চাগুলো।

তাকে সমর্থন জানিয়ে জাকির হোসাইন নামের আরেকজন মন্তব্য করেছেন, আপাততঃ এর চেয়ে ভালো কোনো পন্থা নেই। যদিও লটারীর মাধ্যমে একটি শিশুর জীবন চলা শুরু হবে তা মেনে নেয়া যায় না।এলাকা ভিত্তিক সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই এর একমাত্র সমাধান।

শিশুদের মনস্ততাত্ত্বিক দিক তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: শিশুদের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতি থাকতে পারে; তবে তা কিছুতেই যেন শিশুদের মনে অতিরিক্ত চাপ তৈরি না করে।

তার মতে, সামগ্রিকভাবে উচিত শিক্ষার মান বাড়ানো এবং বেশি বেতন দিয়ে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা। ভালো স্কুলগুলোর শাখা এবং এলাকাভিত্তিক কোটা আরও বাড়াতে হবে। তাতে একই এলাকার শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং শিশুদের বিচ্ছিন্নতাবোধ কমে যাবে।

তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষা বা লটারি কোনটিই আসলে সমাধান নয়। এ জন্য প্রয়োজন ভালো স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো এবং মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা। সব শিশু ভালো শিক্ষার সুযোগ পায়।সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ভর্তি পরীক্ষা বা লটারি দুইয়ের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়া বা বঞ্চিত করা। কিন্তু এটাতো লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। যাতে সব শিশুর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়, আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সেটা। এ জন্য ভালো স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি, মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নত করতে হবে।

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আবশ্যিকভাবে লটারির মাধমে শিক্ষার্থী নির্বাচন করার কথা উল্লেখ করে আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তির নীতিমালায় বলা হয়েছে, লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থীর তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি শূন্য আসনের সমান সংখ্যক অপেক্ষমাণ তালিকা প্রস্তুত রাখতে হবে। তবে যমজ সন্তানের একজন আগে থেকে অধ্যায়নরত থাকলে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।

আর দ্বিতীয়-অষ্টম শ্রেণির শূন্য আসনে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাক্রম অনুসারে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নবম শ্রেণীর ক্ষেত্রে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের প্রস্তুত করা মেধাক্রম অনুসারে নিজ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির পর অবশিষ্ট শূন্য আসনে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য নির্ধারিত ভর্তি কমিটির বাছাই করার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে।

এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে সরকারি বিদ্যালয় এলাকায় ওই এলাকার ৪০ শতাংশ কোটা রেখে অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ আসন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে মোট আসনের ১০ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

নীতিমালায় পরীক্ষার মানবণ্টন উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পূর্ণমান-৫০, এর মধ্যে বাংলা-১৫, ইংরেজি-১৫, গণিত-২০ নম্বর। ভর্তি পরীক্ষার সময় ১ ঘণ্টা। চতুর্থ-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পূর্ণমান-১০০। এর মধ্যে বাংলা-৩০, ইংরেজি-৩০, গণিত-৪০ এবং ভর্তি পরীক্ষার সময় ২ ঘণ্টা।