১৪ সেপ্টেম্বর আমরা যাই শাহপরীর দ্বীপ। আগেও কয়েকবার শাহপরীর দ্বীপে যাওয়া হয়েছে। তবে এবারের লক্ষ্য ভিন্ন। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে তখন প্রতিদিনই আগুন জ্বলছে। তবে আগুনের দৃশ্য ধোঁয়ার বাইরে কিছুই চোখে পড়ছে না। দিনের আলোতে যদিও আগুন কম দেখা যায়। তাই আগুনের ভাল ছবির জন্য অপেক্ষা করি সন্ধ্য পর্যন্ত। তবে এদিন সন্ধ্যার পর সীমান্তের নতুন কোন আগুন দেওয়ার ঘটনা না ঘটায় ফিরে আসি। পরদিন আবার সন্ধ্যায় আমরা গিয়ে দাড়াই শাহপরীর দ্বীপে।
এদিন আমরা সফল হয় ভাল কিছু ছবি ফ্রেমবন্দি করতে। নাফ নদীর একেবারে পাড়ে গিয়ে আমরা দেখতে পাই একটি জ্বলন্ত গ্রাম। আগুনের লেলিহান সে শিখা আমাদের চোখের সামনেই। সন্ধ্যার পর রাত নেমে এলো। আগুন যেন আরও স্পষ্ট। আগুনের সেই ছবি পেয়ে আমরা কিছু আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। তবে সেটা এজন্য নয় যে রোহিঙ্গাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে, সংবাদে নতুন মাত্রা যোগ করা যাবে, সেটা ভেবে। আগুনের এ ছবি পেয়ে আনন্দই লাগছিলো। যদিও বিষয়টি নিয়ে পরে খারাপ লেগেছে। বিষয়টি যেন কিছুটা এমন, কারও পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। আমরা আনন্দিত যে জ্বলন্ত গ্রামের ছবি দেখাতে পারছি। কিন্তু যার ঘর পুড়ছে তার কষ্ট তখনও আমার কল্পনার বাইরে।
অ্যামনেস্টির স্যাটেলাইট ছবি
রোহিঙ্গারাই নিজেদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে এমন প্রচারণার জন্যই ৫ সেপ্টেম্বর একটি মিডিয়া ট্যুরে আয়োজন করেছিলো মিয়ানমার সরকার। তবে সেখানে বিবিসির জনাথন হেড যে প্রতিবেদন করেছিলেন তা হয়ত মনোপুত হয়নি জান্তা সরকারের। রাখাইন রাজ্য নিয়ে যা প্রচারিত হচ্ছে তা সত্য নয় বারবারই মিয়ানমার এমন দাবি করে আসছে। এমন অবস্থায় মিয়ানমার সরকারের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্যাটেলাইট ছবি প্রচার করে। ছবি দিয়ে সংস্থাটি জানায়, রোহিঙ্গা গ্রামগুলো জ্বলছে সেনাবাহিনীর দেওয়া আগুনেই। এগুলো অসতর্কতাবশত কোনো কাজ নয়, বরং পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে।
এ দাবির পেছনে প্রমাণ স্বরূপ রয়েছে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া বেশ কিছু ছবি। পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা গ্রাম এখন সম্পূর্ণ খালি, খোদ মিয়ানমার সরকার এ তথ্য দিয়েছে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলার বর্ণনায় এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ামারের সেনাবাহিনী এক একটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলছে, পলায়নরত গ্রামবাসীর উপর নির্বিচারে গুলি ছুড়ছে এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।’ স্যাটেলাইটের ছবিতে ২৫ অগাস্টের পর লোকবসতি আছে এমন অন্তত ৮০টি জায়গায় বড় ধরনের অগ্নিকান্ড শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় অ্যামনেস্টি। এতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অংশ নেয় স্থানীয় সহযোগি গোষ্ঠীগুলো। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং তাদের সহযোগি কিছু সংঘবদ্ধ দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জ্বালাও পোড়াও, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসানের উদ্বৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়নের লক্ষ্য নিয়ে যে গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে এই ছবিগুলো তার অকাট্য প্রমাণ। এটা জাতিগত নির্মূল অভিযান, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।’
জীবন নিয়ে পালিয়ে তখন পর্যন্ত প্রায় চার লক্ষ রোহিঙ্গা (পরবর্তিকালে ৬ লাখ ছাড়ায়) বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হয় যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তবে বছর শেষে তা দশ লাখে গিয়ে ঠেকতে পারে। অ্যামনেস্টির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘রাখাইনে সুপরিকল্পিতভাবে সহিংসতা চালানো হচ্ছে।’ অ্যামনেস্টি’র তথ্যে দেখা যায়, যেসব জায়গায় বর্তমানে আগুন দেওয়া হয়েছে সেখানে আগের চার বছরের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে কোনো অগ্নিসংযোগের ঘটনা দেখা যায়নি। এবার শুধুমাত্র বেছে বেছে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতেই আগুন দেয়া হয়েছে। তবে যেসব গ্রামে রোহিঙ্গা এবং রাখাইনরা পাশাপাশি বাস করে, সেখানে রাখাইন বাড়িগুলো আগুনের হাত থেকে বেঁচে গেছে।
তখন পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর গণহত্যা আর ভয়ংকর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে ১১শ’র বেশি রোহিঙ্গা শিশু পরিবার ছাড়া অচেনাদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। পরিবার ছাড়া পালিয়ে আসা এ সব শিশুর বেশির ভাগেরই বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে। আবার অনেকে পালানোর সময় তাদের স্বজনকে হারিয়ে ফেলেছে। পরে অপরিচিত লোকজনকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে এসেছে। উখিয়ার বালুখালীতে আমার পরিচয় হয়, মোহাম্মদ রমিজ নামের ১২ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে। সে জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে গ্রামে তারা বাস করত তা আক্রান্ত হলে, সে অচেনা একদল মানুষের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। তার বাবা-মা কোথায় সে তা জানে না।
রমিজ বলে, ‘আমি গাছের পাতা এবং পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম।’ এসব শিশুর অনেকেরই চোখের সামনে তাদের পরিবারের সদস্যদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এদিকে একা একা বাংলাদেশে পাড়ি জমানো শিশুরা যৌন হয়রানি, মানব পাচার এবং মানসিক আঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানায় ইউনিসেফ। এসব শিশুর অনেকের শরীরে বুলেটের আঘাত এবং বিস্ফোরণের ক্ষতচিহ্নও রয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ পরিবারই ছিলো পুরুষশূন্য। সাধারণত একজন নারী, তার সঙ্গে ৬-৭ টি সন্তান এমন পরিবারই ছিলো বেশি। রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশই শিশু এমন তথ্য জানায় জাতিসংঘ। এদের মধ্যে ১২ হাজারই ছিলো এক বছরের কম বয়সী শিশু। তখন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষেই বিবৃতি নিয়মিত বিবৃতি দিচ্ছে।
এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেন, ‘আমি মনে করি, এই জনগোষ্ঠীর পাশে এখন বিশ্ববাসীকে দাঁড়াতে হবে। একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তাদের সঙ্গে কী আচরণ করা উচিত, সেই কথা বলতে হবে। এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, এই নির্মমতা বন্ধ করতেই হবে।’ রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না করলে মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপের হুমকি দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। নিন্দার ঝড় বইতে থাকে সারাবিশ্বেই।(চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।