অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করেই অশান্ত পাহাড়। আর এই অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ভূমির অধিকারকে নিয়ে। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক ডামাডোল। কয়েকটি পক্ষ পার্বত্য এলাকায় যার যার অবস্থান থেকে তার অধিকার রক্ষায় সময় সময় আন্দোলন করে চলেছে। আর তাতেই তৈরি এই সংঘাত।
শান্তি চুক্তির প্রায় দুই দশকেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য এলাকায়। এক পক্ষের এই সরকারের কাছেই প্রত্যাশা, যে তাদের দাবি অন্য কোনো সরকার হইতো বাস্তবায়ন করবে না। ফলে এখনই আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হবে। আর অন্য পক্ষ মনে করছে এই সরকার এমন কিছু করবে যাতে তাদের স্বার্থ বলতে কিছুই থাকবে না।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর, পার্বত্য অঞ্চলে যে চুক্তি হয়েছে তার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু কতটুকু শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা দেখার বিষয়।
পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি, নীতিনির্ধারক মহলের অনেকে এবং অনেক সংগঠনের ব্যক্তি প্রায় সময়ই খুবই দৃঢ়ভাবে বক্তব্য ও অঙ্গীকার দিয়ে থাকেন। কিন্তু তবুও ১৯ বছরে চুক্তির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে চুক্তির ধারা বাস্তবায়নের সংখ্যা হিসেব না করে বস্তুনিষ্টভাবে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটাই মূল বিষয়।
অস্থিত্ব রক্ষা, ভূমি, সংস্কৃতি সর্বোপরি আন্তঃপরিচয় নির্ধারণের জন্য এক এক পক্ষ এক এক অবস্থান থেকে আন্দোলন করেই আসছে। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার ও পাহাড়ীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ও তাদের প্রতিপক্ষ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও আছে।
পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ীদের মধ্যে যেমন কয়েকটি পক্ষ আছে তেমনই আছে বাঙ্গালীদের মধ্যেও। শুধু বাঙ্গালী-পাহাড়ী দ্বন্দ্ব নয়। ভূমির অধিকার আদায়ে শংকিত যেমন বাঙ্গালি তেমনই পাহাড়ীরাও। কোনো কোনো বাঙ্গালি মনে করছেন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধন হলে পাহাড় থেকে তাদেরকে চলে যেতে হবে। এখানের সব জমি পাহাড়ীদের দিয়ে দিতে হবে। কেউ মনে করছেন, ‘আদিবাসী’ শব্দটি সাংবিধানিকভাবে মেনে নিলে এই অঞ্চল শুধু পাহাড়ীদেরই হয়ে যাবে। ফলে কোনোভাবেই ভূমি কমিশন সংশোধন হতে দেয়া যাবে না। এবং ‘আদিবাস’ শব্দটিও সাংবিধানিক অধিকারে আনা যাবে না। অন্যপক্ষ মনে করছেন, ভূমি কমিশন আইন যথাযথভাবে সংশোধন হচ্ছে না। এর ফলে যেসব পাহাড়ী আগে ভূমির অধিকার হারিয়েছে তারাও আবার অধিকার ফিরে পাবে না। তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে জনসংহতি সমিতির সুপারিশ অনুযায়ি সংশোধন দরকার। আর ‘আদিবাসী’ শব্দটির সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ি যা যা বিষয় থাকা লাগে তার সব কিছুই আছে। তবে কেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্টি শব্দ ব্যবহার হবে? আদিবাসী শব্দটি সাংবিধানিকভাবে ব্যবহার না করলে নিজেদের পরিচয় ঠিকভাবে হবে না। এই সব বিষয় নিয়ে কেউ ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করতে দেবে না। কেউ করবে। কেউ মনে করছে জমি পাব না। কেউ মনে করছে যা আছে তা হারাবো। এইসব অবস্থান থেকেই পাহাড়ে অশান্তি।
আবার একটি পক্ষ সাধারণ বাঙ্গালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে সরকারের নেয়া কার্যক্রমকে মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে পরিবেশ অশান্ত করে তুলছে। যারাই সেখানে অবস্থান করছে তাদের স্বার্থ বিরোধী কথা প্রচার করছে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে দ্রুত বিরোধ ছড়িয়ে পরছে।
সরকারী দলের নেতারা বলছেন, পাহাড়ের সংগঠনগুলো সংশোধিত ভূমি আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষকে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত করে তুলছে। ফলে স্থানীয় আন্দোলনের যে কোনো কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালি ও পাহাড়ীরা খুব সহজেই একে অন্যের প্রতি ভুল বোঝাবুঝিতে জড়িয়ে পড়ছে।
পাহাড়ী গ্রাম-গঞ্জে, যানবাহনে ও হাট-বাজারে এক শ্রেণীর উপজাতীয় অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজের তৎপরতাও বেড়েছে। পাহাড়ে এখন বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে যে দলগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্র। অর্থ আর অস্ত্রের যোগান পেয়ে সন্ত্রাসী এই দল খুব দ্রুত নিজেদের সংগঠিত করে তুলছে বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে ভয়ংকর এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী নাড়াইছড়ি, বাবুছড়া, মেরুং, পানছড়ি, লক্ষীছড়ি, মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, কাউখালী, লংগদু, বরকল ও নানিয়ারচর উপজেলা।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে দেশের নাগরিককে বাঙ্গালিকরণের যে কথা বলা হয়েছে আবার অপরদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী স্বীকৃতির ব্যাপারটি একধরনের দ্বৈততা প্রকাশ করছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে পার্বত্যবাসীদের জীবন জড়িত তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করেছে। কিন্তু চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করছে জনসংহতি সমিতি। তাদের মতে, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এজন্য আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী হস্তান্তর ও কার্যকরকরণ এবং এসব পরিষদের নির্বাচন করা; এক্ষেত্রে নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা; সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা; সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধিত) ইত্যাদি আইনগুলোকে কার্যকর আইন হিসেবে সংবিধানের প্রথম তফসিলে অন্তর্ভূক্ত করা; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)