দুই শিশু সন্তানের মা আনোয়ারা যখন পরিবার নিয়ে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন তিনি ভেবেছিলেন, যাত্রা কষ্টের হলেও তারা এক সময় ভালো আর নিরাপদ একটা ভবিষ্যৎ পাবেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন গিয়ে ঠেকল অথৈ জলের গভীর সমুদ্রে, যখন তারা অন্য অনেকের সাথে কয়েক সপ্তাহ বন জঙ্গল অতিক্রম করে পরিশেষে নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় ডুবে যায় নৌকাটি।
নৌকার সঙ্গে হারিয়ে যায় আনোয়ারার দুই শিশু কন্যাও।
সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এমনই একজনের যন্ত্রণাময় কাহিনীর বর্ণনা উঠে এসেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ফেসবুক পেজে। নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ‘আনোয়ারা’ দিয়ে ওই রোহিঙ্গা নারীর গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
নৌকাডুবিতে মেয়ে হারানোর ঘটনা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন আনোয়ারা। বলেন, ‘আমি আমার পাঁচ মাস বয়সী ছোট মেয়ে মিনারাকে (ছদ্মনাম) কাঁধে নিয়ে ছিলাম। ওদিকে আমার চার বছরের আরেক মেয়ে শাহিনা (ছদ্মনাম) আমার চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল।’
আনোয়ারা জানান, যেখানে নৌকাটা ডুবে গিয়েছিল সেখানে পানি ছিল অনেক গভীর। ‘আমি একটি নৌকায় অনেকক্ষণ আঁকড়ে থাকতে পেরেছিলাম যেন পানির নিচে চলে না যাই। তারপর আমি কিছু কাঠের টুকরো খুঁজে পেয়ে তীরে আসতে সফল হই। আমার মনে হয় আমি এক ঘণ্টারও বেশি সময় পানিতে ছিলাম।’
গত ১০ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করতে কক্সবাজার যান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। ওইদিন সকালে ৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর একটি নতুন দল ইউএনএইচসিআর-এর ট্রানজিট সেন্টারে যায়।
তাদের সঙ্গে দেখা করেন বরিস জনসন। ওই দলে ছিলেন আনোয়ারা। সেদিন তাদের সবাইকে অস্থায়ী বাসস্থান, গরম খাবার এবং মানসিক সান্ত্বনা দেয়া হয়।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার মত কঠিন সিদ্ধান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে আনোয়ারা বলেন, ‘মিয়ানমারে আমরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলাম। নৌকায় করে বাংলাদেশে আসার সময় মাঝিকে প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক ব্যাক্তির জন্য ৫০ হাজার কিয়াত দিতে হয়েছিল, যা প্রায় ৩৭ মার্কিন ডলারের সমান। আমাদের গ্রামটাকে দখল করে সেটাকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। আমরা সপ্তাহর পর সপ্তাহ বনে কাটিয়েছি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম আমরা।’
আনোয়ারার স্বামীকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে আর দেখেননি আনোয়ারা। লোকমুখে শুনেছেন তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ‘আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়েদের নিয়ে এখানে চলে আসলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব। কিন্তু তারা তো এখন মৃত। আমি জানি না কিভাবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠবো।’
‘কাছের মানুষ বলতে এখন শুধু আমার বয়স্ক বাবা-মা আছে। তারা আমাকে হয়তো কিছু শক্তি যোগাবে।’ আনোয়ারার পরিবার বলতে এখন শুধু তারা আছেন। তাদের জন্য হলেও শক্ত থাকতে চান আনোয়ারা।