চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পাঁচ বছরে সাগর-রুনির পরিবারে হতাশার পাহাড়

গত পাঁচ বছরে সাগর-রুনির পরিবারে তৈরি হয়েছে পাহাড় সমান হতাশা। মেহেরুন রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা পুরোপুরি বাকরুদ্ধ। গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে অনীহা তার। প্রায় একই ধরণের অভিব্যক্তি জানালেও সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির এখনও আশা ছাড়েননি। তবে, পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় রুনির ছোটভাই নওশের আলম রোমান বিরক্ত।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। নির্মম ও আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের পর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের আশ্বাস থাকলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। বছর ঘুরে ১১ ফেব্রুয়ারি আসার আগে ও পরে গণমাধ্যমে কিছু শিরোনাম হয় মামলার তদন্ত কার্যক্রম সর্ম্পকে, এরপরে আবার তা চাপা পড়ে যায়। এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৪৬টি ধার্য তারিখ অতিবাহিত হয়েছে। সর্বশেষ ২১ মার্চ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সাগর-রুনি পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে হতাশ। ধীরে ধীরে নিষ্ঠুর বাস্তবতার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন তারা।

বিচার কি হবে?

সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির

নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম, হয়তো সাগর-রুনির মৃত্যুবার্ষিকীর আগে এইদিন (৮ ফেব্রুয়ারি, প্রতিবেদন দাখিলে আগের সর্বশেষ তারিখ) একটা কিছু হবে। নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুদিন আগে বাসায় এসেছিলেন, তিনিও বলেছিলেন, ধৈর্য্য ধরেন- বিচার পাবেন। তবে তিনি বলেননি কবে পাবো। আমারতো মনে হয় দেশের জনগণও হয়তো আশায় ছিলেন যে যদি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিচার হতে পারে তাহলে সাগর-রুনি হত্যার বিচারও হবে।

‘তদন্ত প্রতিবেদন অন্তত জমা দিলেও বলতে পারবো যে, কিছু একটা আগাচ্ছে। আল্লাহর কাছে হাত তুলে অনেক কেঁদেছি, নফল নামাজ পড়ে মানত করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তারপরেও আমি বিচারের বিষয়ে আশাবাদী। সাত খুনের বিচার হতে পারলে সাগর-রুনি হত্যার বিচারও একদিন হবে।’

নিহত মেহেরুন রুনির ছোটভাই নওশের আলম রোমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা খুবই হতাশ তদন্ত ও মামলার কার্যক্রম সর্ম্পকে। শুধুমাত্র মৃত্যুবার্ষিকীর আগ দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ফোনে যোগাযোগ করেন ‘আমরা কেমন আছি’, তা জানতে চান। যা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। প্রথম প্রথম তাদের জিজ্ঞেস করতাম মামলার তদন্ত অগ্রগতি সর্ম্পকে, কিন্তু এখন আর করি না। ‘তদন্তে একটু সময় লাগবে’, এই উত্তর ছাড়া তাদের মুখ থেকে আর কিছু শুনতে পাইনি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত র‌্যাব সদর দফতরের সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ‘কি পয়েন্টে’ তদন্ত চলছে। আশাকরি খুব শিগগিরই প্রথাগতভাবে অগ্রগতি হবে।

হত্যাকাণ্ডের পরে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের জব্দ করা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ও ব্যবহার্য সামগ্রী কোথায় আছে, মাঝে অনেকদিন সে তথ্যও জানতে পারেনি সাগর-রুনির পরিবার। এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলের সাথে সাথে অনেকটা আবার প্রথম থেকে তদন্ত শুরু হওয়ার কায়দায় তদন্ত চলছে বলে হতাশা জানান নওশের আলম রোমান।

পরিবারের পাশে কারা?

মর্মান্তিক ওই হত্যাকাণ্ডের পর মেঘ ও পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দেওয়া সরকারের উচ্চ পর্যায়সহ বিভিন্নজন আর যোগাযোগ রাখেনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এককালীন কয়েক লাখ টাকা, একটি গ্রুপ এবং সাংবাদিক সংগঠন থেকে কিছু অর্থ সাহায্যের বাইরে আর কোন কিছুই সাগর-রুনির পরিবার গ্রহণ করেনি বলেও তারা জানান। আত্মসম্মানের জায়গা থেকে তারা এ বিষয়ে সাহায্য নিতে বিব্রত বোধ করছেন।

নিহত মেহেরুন রুনির ছোটভাই নওশের আলম রোমান ও মেঘ

পারতপক্ষে গণমাধ্যম থেকে মেঘকে দূরে রাখেন সাগর-রুনি পরিবার। শিশুমনে যেন কোন ক্ষত তৈরি না হয় সেব্যাপারে তারা সচেতন। তবে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে কোনো ইভেন্ট হলে সেসবের আয়োজক ও মান দেখে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন।

সাগর-রুনি বেঁচে থাকতে তাদের কাছের যেসব বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন, তাদের অনেকের সাথে যোগাযোগ নেই সাগর-রুনির পরিবাবের। তবে নতুন দু-তিনজন কাছের মানুষ তৈরি হয়েছে মেঘের শুভাকাঙ্খী হিসেবে।

সাগর সরওয়ারের মা বলেন, আমার ধারণা সাগর-রুনিকে তাদের বন্ধুরা ভুলে যায়নি। তবে বছর যতই যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা হলেও কমে যাচ্ছে। এখনও অবশ্য অনেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন আমার সঙ্গে। আমি যখন গ্রামে যাই বা অন্য কোথাও যাই, তখন টের পাই দেশের প্রতিটি মানুষের মনে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড স্মরণীয় হয়ে আছে।

‘এটা কি ভুলে যাওয়ার মতো কোন বিষয়?’

রুনির ছোটভাই নওশের আলম রোমান প্রায় একই ধরণের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। তবে তিনি নতুন কিছু শুভাকাঙ্খীর প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা  সুখে-অসুখে পরিবারের সদস্যদের চেয়েও বেশী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

কেমন আছে মেঘ?

সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি নিহত হওয়ার পর থেকেই তাদের একমাত্র ছেলে মাহীর সরওয়ার মেঘের পুরো দায়িত্ব অনেকটা বাবা-মায়ের মতো সামলাচ্ছেন রোমান। মেঘকে স্কুলে নেওয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সকল দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ধর্মীয় উৎসব ঈদ থেকে শুরু করে মেঘের স্কুলের ছোটবড় সব অনুষ্ঠানে রোমান ছায়ার মতো মেঘের পাশে আছেন। মাঝে মাঝে দাদী বাড়ি যায় মেঘ। তবে স্কুল-পড়াশোনা আর কার সঙ্গে কখন যাবে সেই জটিলতায়, দাদীকে একটু কম দেখতে যাওয়া হয়।

নিহত রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা

মেঘের নানী ও নিহত রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা একবুক কষ্ট নিয়ে নানাবিধ অসুস্থতার মধ্যে দিন পার করছেন। মেঘের সাথেই কাটে তার সারাদিন। মেঘের পছন্দ-অপছন্দের খাওয়া-দাওয়া আর দৈনন্দিন কাজে নানী নুরুন্নাহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। দাদী বাড়িতে মেঘ মাঝে মাঝে গেলেও মামা আর নানীকে ঘিরেই তার জীবন বয়ে যাচ্ছে।

নিহত রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নতুন করে কী আর বলবো! ভাল লাগে না। আমার শরীরও ভাল না। কষ্ট আর অসুস্থতা নিয়ে আল্লাহ মনে হয় বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধু মেঘের জন্য।

মেঘ সর্ম্পকে রোমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মেঘ খুবই লক্ষী একটা ছেলে। সে তার বাবার মতো চুপচাপ কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান। পরিবারের ভালমন্দ থেকে শুরু করে বাস্তব পরিস্থিতি খুবই ভাল বুঝতে পারে। অনেক বাচ্চা যেমন ঝামেলা তৈরি করে, মেঘ তা মোটেও করে না। কম্পিউটার-মোবাইল আর তার পড়াশোনা নিয়ে অন্য সাধারণ বাচ্চাদের মতো সে বেড়ে উঠছে।

‘আমরা চেষ্টা করছি সম্ভব সবকিছু করতে।’

বাবা-মায়ের না থাকার বিষয়ে মেঘের উপলব্ধি সর্ম্পকে রোমান আরও বলেন, মেঘ মাঝে মাঝে তাদের পুরাতন ছবির অ্যালবাম ও কম্পিউটারে রাখা ছবি দেখে। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বাবা-মায়ের সাথে কোনো বাচ্চার উপস্থিতি দেখলে কিছুটা বিচলিত হয়, সেসময় আমাকে তার পাশে চায়। এছাড়া সে খুবই বাধ্য ছেলে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির একমাত্র ছেলে মাহীর সরওয়ার মেঘ

মেঘের দাদী ও সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির বলেন, মেঘ মাঝে মাঝে আসে আমার এখানে। তবে তা খুবই কম। ওকে দেখলে আমার সাগরের ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আমার কাছে ও আরেকটু বেশী থাকলে বা এলে আরো ভাল লাগতো, কিন্তু ওরাও (মেঘের মামারা) ব্যস্ত থাকে আর আমারও বয়স হয়েছে: তাই একা যেতে পারি না। মেঘের ছবি দেখে দেখে সাগরের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছি।

‘আল্লাহ যেনো আমাকে বেঁচে থাকতে থাকতে আমার ছেলের আর বৌমার হত্যার বিচার দেখে যেতে দেন।’

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সরওয়ার ওরফে সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। পরের দিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

প্রথমে মামলার তদন্ত  কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মামলার পর রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আটজনকে আটক করা হয়। অন্যরা হলো—রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, পলাশ রুদ্র পাল, তানভীর, আবু সাঈদ ও বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির।  এর মধ্যে মধ্যে পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান জামিনে রয়েছে।

ছবি- তানভীর আশিক