কথা কাটাকাটির জেরে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন সালাউদ্দিন শরীফকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সারাদেশে। এবার সেই বিষয় নিয়েই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন ব্র্যাকের অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তা শরিফুল হাসান।
ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, নিজের শিশু সন্তানের সামনে চড় খেলেন, অপদস্থ হলেন, বদলি হলেন, যিনি মারলেন তার সাথে সমঝোতা করতে হলো। এরপর আবার আদালতেও হাজির হতে হবে। বাংলাদেশে বলেই এটা সম্ভব। এখানে খলনায়করা নায়ক, অার নির্যাতিতরাই অপরাধী।
লক্ষ্মীপুরের ঘটনার সারাংশ অামার কাছে মোটামুটি এমনই। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাবেক অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সিভিল সার্জনকে কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনায় লক্ষীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে আগামী ১৩ ডিসেম্বর তলব করেছেন উচ্চ আদালত। আদালত চাইলে কাউকে ডাকতেই পারেন। সেটা আদালতের এখতিয়ার। তবে আমি খুব অবাক হয়ে ভাবি শিক্ষিত একজন মানুষ কী করে আরেকজনের সাথে কথা বলার সময় তাকে চড় মারেন।
সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ কখনো কারো গায়ে হাত তুলতে পারেন এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। সেদিন যে শিশুরা এই ঘটনা দেখেছে তারা ভবিষ্যতে কী শিখবে?
নিজের কৌতুহল থেকে সেদিনের ঘটনা জানার চেষ্টা করলাম। স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে যতোটা জেনেছি স্কুল থেকে বাচ্চাদের বের হওয়ার সময় ডাক্তার মহোদয়ের বড় ছেলে তার সন্তানকে নিতে গেট দিয়ে ঢুকছিলেন। অার এডিসি দাঁড়িয়েছিলেন তার সন্তানের জন্য। ওইভাবে ডাক্তার সাহেবের বড় ছেলের প্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। যিনি ভুল করেছেন তিনি বা দুজনেই সরি বলতে পারতেন। কিন্তু ঘটনা হলো উল্টো।
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ডাক্তার সাহেব এডিসিকে চড় মারলেন। অামি নিশ্চিত হয়ে বলছি চড় মেরেছেন। স্কুলের পাশের দোকানদার কাজল ঘটনা দেখতে পেয়ে দৌড়ে অাসেন। কারণ তার কাছে এডিসি ডিসি সবই এক। তিনি ভেবেছিলন ডিসিকে কেউ মেরেছে। তিনি দ্রুত এডিসি সাহেবকে একটা টুলে বসতে দেন। এ সময় ডাক্তার সাহেবের বড় ছেলে নাকি এডিসিকে আবার হুমকি দেন। বলেন লাথি মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেবেন।
আমি শুধু ভাবি সরকারি একজন কর্মকর্তা কিংবা একজন সাধারণ মানুষকে তার শিশু সন্তানের সামনে আরেকজন চড় মারছে। যে লোকটা চড় খেলো তার মানসিক অবস্থাটা কী হয়? সবচেয়ে অবাক বিষয় হলে যিনি চড় খেয়েছেন এবং সদরের ইউএনও দুজনেই লক্ষ্মীপুরের ভালো সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। মারও তারা খেলেন, বদলিও তারা হলেন। আমার কোন তথ্য নিয়ে কারো সন্দেহ থাকলে নিজেরা যাচাই করতে পারেন। সেখানকার সাংবাদিক এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
এরপরে শরিফুল হাসান লিখেছেন, এবার আসি কথায় কথায় মোবাইল কোর্ট প্রসঙ্গে। আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রায়ই এমনভাবে কথা বলেন যেন মোবাইল কোর্টই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করে ফেলছে। সব বাল্যবিবাহ মোবাইল কোর্টের কারণে বন্ধ। দেশে খাবারে কোন ভেজাল নেই, মাদক নেই। এক মোবাইল কোর্ট পুরো দেশটা ঠিক করে ফেলছে। আমার মনে হয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এই ধারণা সবার আগে বদলানো উচিত যে মোবাইল কোর্টেই সব সমস্যার সমাধান।
এই ধারণার কারণেই আপনারা মার খেলেন, অপদস্থ হলেন। এরপরেও গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের সেই ঘটনা না জানিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করলেন। এটা কী কোন সমাধান হতে পারে? অামি জানি না চড় খাওয়ার পর সেটা কেন চেপে গেলেন অাপনারা? কেন সাংবাদিকদের বললেন, মার খাওয়ার ঘটনা চেপে যেতে? এদেশে মার খাওয়াটা লজ্জার কিন্তু মারাটা লজ্জার নয়। এদেশে ধর্ষিতা হওয়াটা লজ্জার, ধর্ষক হওয়া নয়।
অামার খুব জানতে ইচ্ছে করে কেন একজন মানুষের গায়ে হাত তোলার কারণে মামলা হবে না? কেন পুলিশ অপরাধীকে ধরবে না? কেন আদালতে সেটার বিচার হবে না? হ্যা আপনারা বলতে পারেন এটা সময়সাপেক্ষ। মূলত সমস্যা এখানেই। আমরা এই দেশে এখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমাদের দেশে ক্ষমতাই সব। সেই ক্ষমতা কখনো মাস্তানদের হাতে, কখনো পুলিশের হাতে, কখনো প্রশাসন বা অন্য কারো হাতে। কিন্তু আইনের শাসন বলে কিছু নেই।
আরেকটা বিষয় আমাকে প্রায়ই আহত করে। বাংলাদেশের পেশাজীবীদের আচরণ। সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি কোন সাংবাদিক অন্যায় আচরণ করেছে সেটা বললে অন্য সাংবাদিকরা রাগ করেন। কেন রে বাবা? আপনি পুলিশ বলে কী সব পুলিশ ভালো? তাহলে একজন পুলিশ যখন অন্যায় আচরণ করে কেন সব পুলিশ তার পক্ষ নেবে? একজন ডাক্তার ভুল করলে কেন সব ডাক্তারকে তার পক্ষই নিতে হবে? তাহলে কেন ডাক্তার নেতারা সেদিন হামলাকারীর পক্ষ নিলো? হ্যা পক্ষ তখুনি নিতে হবে, যদি তিনি অন্যায়ের শিকার হন। কিন্তু অাশ্চর্য বিষয় হলো ভালো কাজ করতে গিয়ে কিংবা এমনিও যদি কেউ বিপদে পড়েন তার পাশে কেউ থাকে না।
অারেক বাস্তবতা হলো, অামরা ভুলকে ভুল বলি না। আমাদের মধ্যে আত্মসমালোচনা তো নেইই, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় এক পেশার লোক আরেকপেশার লোককে ভয়াবহভাবে ঘৃণা কিংবা অপছন্দ করে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ধারণা তারা বাদে বাকিরা সেভাবে কাজ করে না। তারা ক্যাডারই না। পররাষ্ট্র ক্যাডারের লোকজন ভাবে তারা সেরা। পুলিশের অাছে অস্ত্র, ক্ষমতা। অাদালত ভাবে অামিই তো সব। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শিক্ষক, ডাক্তার, কৃষি ক্যাডারের লোকজন তো নানা বৈষম্যের শিকার। এসব কারণে পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধার বদলে অাছে হিংসা বিদ্বেষ।
এই যে এক পেশার লোকজন অন্য পেশাকে ছোট করে নিজেরা বড় হতে চায়, সেটা করতে গিয়ে তারা নিজেদের অন্যায়গুলো আর দেখে না। ফলে আমাদের দেশে সবক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরা দিনকে দিন স্থায়ী রূপ পাচ্ছে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে মানবিক মানুষেরা। মানবিক ও সৎ যে পুলিশ কর্মকর্তা ভালো থাকতে চায় তাকে তার বাহিনীতে নানা সমস্যায় থাকতে হয়। প্রশাসনের যে কর্মকতাটি সৎ যিনি সবসময় মানুষের জন্য করতে চান, নিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরুতে চান তাকে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। বিপদে পড়লে তার পাশে কেউ থাকে না। ভালো করলে পুরো বাহিনী তার ক্রেডিট নিতে চায়। যে বিচারক বা সাংবাদিক সততার সাথে বাঁচতে চান তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। যে ডাক্তার চান তার পেশার অনিয়মগুলো দূর হোক তাকে পড়তে হয় বিপাকে। আর এভাবে প্রতিদিন মানবিক মানুষগুলোকে কষ্ট পেতে হয় এই দেশে। আর অমানুষগুলো প্রতিদিন অন্যায় করে, চড় মারার পরেও, ঘুষ খাওয়ার পরেও তারা ক্ষমতার কারণে সবাইকে পাশে পায়।
সবশেষে সাবেক সাংবাদিক শরিফুল হাসান লিখেছেন, কথা হলো সমস্যার সমাধান কী? আমি যেটুকু বুঝি সমস্যার সমাধান একটাই। ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলা। কোন পুলিশ অন্যায় করলে তার পুরো বাহিনীকে বুঝিয়ে দিতে হবে তিনি অন্যায় করেছেন। কোন ডাক্তার ভুল করলে বাকিদের উচিত নয় ধর্মঘট ডেকে তার পাশে থাকা। লক্ষ্মীপুরের ডাক্তার সাহেব কোনভাবেই এডিসিকে চড় মারতে পারেন না। এই ঘটনা অাড়াল করাও কোন সমাধান নয়। অাবার এ নিয়ে মোবাইল কোর্ট করে তাকে জেল দেয়া সমাধান নয়। একই কথা প্রযোজ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে। কেউ ভালো কাজ করলে পাশে থাকতে হবে, অন্যায় করলে নয়।
আমি জানি না কবে আমরা সব স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সত্যকে সত্য, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে পারবো। জানি না ক্ষমতার চর্চার বদলে অামরা মানবিকতার চর্চা করতে পারবো। জানি না অামি, তবু অামি অাশাবাদী হই। কোন একদিন নিশ্চয়ই অন্ধকারগুলো দূর হবে। খুব অানন্দ নিয়ে তৃপ্তি নিয়ে নিশ্চয়ই একদিন বলতে পারবো শুভ সকাল বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, লক্ষ্মীপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) শেখ মুর্শিদুল ইসলামের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সালাউদ্দিন শরীফকে আটকের পর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৪ ডিসেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরুজ্জামান তাকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।