জীবনে অনেক সময় অনেক কিছু হয়, এক ঝটকায় সব ওলোট-পালোট হয়ে যায়। মোড় ঘুরে যায় এবং কথায় আছে না? ” যা হয়, ভালোর জন্যই হয়”! হয়তো এইটাও সেরকম কিছুই ছিলো।
ছোট থেকেই রাজ্যের কাজে আমার আগ্রহ। পড়াশোনাটা বাদে। খুব মেধাবী ছিলাম না, আবার এলেবেলে ও ছিলাম না। বরাবর ই একটা মাঝারি ভালো মানের রেজাল্ট করেছি। এইচএসসির সময় কেমিস্ট্রি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন বন্ধুকে সাহায্য করার এক ভুলের কারণে আমার লিখিত পরীক্ষার খাতা নিয়ে নেয়া হয়। সৃজনশীল পরীক্ষা, ১৯ নম্বরের উত্তর করেছিলাম মাত্র, ১৭ তে পাশ। কোনমতে অবজেক্টিভ দিয়ে আমি হল থেকে স্তব্ধ হয়ে বের হলাম। হাতের সব ফেলে দিলাম রাস্তায়। মা, বন্ধু সবাইকে রেখে ঠনঠনে রোদে হাঁটা ধরলাম রাস্তায়। কতক্ষণ হেঁটেছি জানিনা। জীবনটা অর্থহীন লাগছিলো ।
বাবাকে ফোন দিলাম, বাবা শুধু এটুকু বললো, ”তুমি বাসায় আসো। আমি তোমাকে এর চেয়ে ভালো করার উপায় বলে দেবো।”
চুপচাপ বাসায় গেলাম। মা আমার সাথে সেদিন থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। পরের ৩ মাস কথা বলেনি। প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা পার করেছি পুরো সময়। আলহামদুলিল্লাহ, সেকেন্ড পার্ট ভালো দিলাম। ভয় ছিলো, সব ভালো হবে, শুধু রেজাল্টে দেখব কেমিস্ট্রি তে ফেল করেছি। না, রেজাল্ট দিলো, সবাই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে খুশি, আমি বাসায় চুপচাপ তাদের অভিবাদন জানিয়ে মন খারাপ করে থাকলাম এক কেমিস্ট্রির জন্য আমার স্বপ্নের জায়গা গুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে। এডমিশনের পুরা টাইম প্রচণ্ড ডিপ্রেশন এ কাটলো। খেতাম না। সারাদিন চোখ বেয়ে পানি পড়ে। শুকিয়ে কাঠ। হঠাৎ ভাল খবর, চান্স পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ। ভর্তি হলাম।
কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলা হলো, সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে থাকবো না। দেশের বাইরে ৭টা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করলাম। বললে গর্ব মনে হতে পারে, But I was accepted in each of them with great offers. এখানে আমার IELTS এর স্কোর অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলো। অস্ট্রেলিয়া তে বেশ ভালো স্কলারশিপ পেলাম। দেশে এডমিশন ক্যান্সেল করে সব কাগজপত্র পাঠালাম, কেমিকৌশল বিভাগে হয়ে গেল সব। তারপর অপেক্ষা, ভিসা আর সেশন শুরুর।
আমি বরাবরই একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। একদিন হঠাত করে মাথায় আসে এই সময় নষ্ট করে কি লাভ, চটজলদি ভর্তি হয়ে গেলাম একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর আন্ডারে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন কোর্স এ। এখানেই হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস ল, প্রোডাকশন এন্ড ডেভেলপিং, ইত্যাদি নিয়ে জানলাম। পাশাপাশি অনলাইনে ই- কমার্স নিয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম। Coursera একটি অসাধারণ অনলাইন প্লাটফর্ম এখানে বিশ্বের হাজারো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিতে পারবেন ঘরে বসে। আস্তে আস্তে জ্ঞান বাড়তে লাগলো, কিন্তু শুধু অর্জন করেই ত হবেনা! প্রয়োগ লাগবে!
একদিন হুট করে দুইটি অনলাইন পেজ খুলে ফেললাম। ৬ হাজার টাকা মূলধন। একা আমি। সাথে কারো কোনো সাপোর্ট নেই। সারাজীবন চ্যালেঞ্জিং সব কাজ করেছি। ২০১৪ সালের মার্চের পরে সেইদিন প্রথম নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম। সাথে সাথে ‘Pastels’ কে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা নিয়ে উঠেপড়ে লাগলাম। তারপর কত দিন পার হলো, কত ঝড় তুফান! আমার ব্যবসায় পার্টনার আসলো, গেলো, অনলাইন আক্রমণের শিকার হয়ে সব হারালাম। আবার একটু একটু করে গড়ে তুললাম। এখন প্যাস্টেলস অনেক বড়। দেশের বড় বড় মিডিয়া, ফ্যাশনদুরস্ত ব্যক্তিরা আমার কাছ থেকে পোশাক নিতে থাকলো। পত্রপত্রিকা আমাকে নিয়ে লেখা শুরু করলো। সবাই জানলো আমার নাম, কাজ, পরিচয়। স্বনামধন্য দুই চলচ্চিত্রে আমার পোশাক নেয়া হলো, আলোচিত মডেল, ফটোগ্রাফাররা কাজের জন্য আমার পোশাক চাইতে থাকলো। সব খুব ভালো যাচ্ছিলো। নিজেকে খুব কনফিডেন্ট লাগতো।
কিন্তু ওই যে সুখে থাকলে দুঃখও দূরে থাকেনা! যাবার সময় এসে গেল। পড়ালেখা, নানান ঝামেলায় নতুন জীবন শুরু, পরে নিজের স্বপ্নের উদ্যোগটা ছেড়ে দিতে হলো সময় আর সুযোগের অভাবে। কিন্তু রক্তে যার নেশা, সে কি আর সহজে দূরে থাকতে পারে? আবার মাথায় পোকা কুটকুট করতে লাগলো। পোশাক নিয়ে কাজ করা অনেক ঝামেলা। কিন্তু ব্যাগ, জুতা, গয়না, গ্যাজেটস নিয়েত করাই যায়!
যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যবসার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর অনুমতিপত্র হাতে পেলাম। বাংলাদেশে বসে যেন বিশ্বের যেকোনো দেশের পণ্য হাতে পায় ক্রেতা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ভালোই চলছে। এখন আমি অনেকগুলো দেশি বিদেশী সংস্থার সাথে কাজ করি সামাজিক উন্নয়নের জন্য। কাজ করি সংবাদ সংস্থাতেও। আমার গল্পে সফলতা খুব কম অংশে আছে। তবে আমার ধারণা, কারো কটু কথায়, অসত্য প্রচারণা বা নিজের অপারগতায় পাত্তা না দিয়ে দাঁত কামড়ে লেগে থাকা উচিত। ভালো কিছু একটা সময়ে হবেই।
তখন যেসব মানুষ কথা বলতো নানারকম, তারাই এখন সফলতার জন্য সাজেশন চায়। আমি হাসি! আমি এখন প্রতিদিন অন্য নারীদের প্রতিবন্ধকতা, সফলতা আর ভেঙে পড়ার গল্প খুঁজে বের করি, তাদের উৎসাহ দেই, পারলে পত্রিকাতে ছাপাই তাদের গল্প। কি যে খুশি হয় তারা! একজন মানুষ এর জীবনের আনন্দময় একটা স্মৃতিতে আমি চিরদিন এর জন্য নথিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি ভাবতেও অসাধারণ লাগে! এই মুহূর্তে আমি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় রওনা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, একটা তরুণ উদ্যোক্তা ও নেতাদের সম্মেলনে অংশ নিতে। এখন, এই মুহূর্তে আমি একজন সুখী মানুষ। আমি বলতে চাই, I believe in everything until it’s proven wrong,because rumor has it!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)