বাংলাদেশে যেকোনো সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি রক্ষার বদলে নিজেদের ‘রাজনৈতিক পাণ্ডিত্য’ জাহির ও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে গিয়ে দলীয় বিবেচনায় বিভিন্ন স্থাপনা ও জায়গার নতুন নামকরণের হিড়িক পড়ে যায়। তবে অনেক সময় আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রায় সব সরকার পুরোনো প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা কিংবা স্থানের ‘নামকরণ-নামবদল’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এরই প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাম বদলের সবশেষ খবর হচ্ছে, পিরোজপুর জেলার ‘জিয়ানগর’ উপজেলার নাম বদলে তার জায়গায় আনা হয়েছে পুরনো ‘ইন্দুরকানি’ নাম। যদিও এক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, উপজেলাটির নাম জিয়ানগর, আর থানার নাম ইন্দুরকানি হওয়ার কারণে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা হওয়ার কারণে তাদের দাবির প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি যতোই বলেন না কেনো, আসলে সমস্যাটা শুধু এখানেই নয়। সমস্যাটা রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায়। আগের সরকারগুলোর মতো এখন যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নাম পরিবর্তন হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তকে এখনই ‘সরকারের আগ্রাসী প্রতিহিংসা’র বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধুর নামে করা সব স্থাপনার নাম পরিবর্তনের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
পাড়ার দখলদার ‘নাইনস্টার গ্রুপ’ আর ‘ডিসকো বয়েজ’র বাগযুদ্ধের মতো সরকারের উদ্দেশ্যে বিএনপি’র এই নেতা বলেছেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসতে পারে তখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববদ্যালয়ের আগের নাম অনুযায়ী পিজি হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে ঢাকা স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু সেতুকে যমুনা সেতু, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারকে মওলানা ভাসানী নভো থিয়েটার করা হবে!
এতে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এই নামকরণের নামে জনসাধারণের টাকার লুটপাট বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্ভর আত্মসমপর্ণকারী রাজাকার ও শর্শীণার তৎকালীন ‘পীর’ পরিচয়দানকারী আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে খুশি করতে তার পিতার নামে স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী থানা ও উপজেলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নেছারাবাদ। এর প্রতিবাদে স্বরূপকাঠীর লাখো মানুষ তখন রাস্তায় নেমে মিছিল ও প্রতিবাদ করেছিলো।
কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ধর্মকে পুঁজি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী স্বৈরাচারী, ভণ্ড এরশাদ স্বরূপকাঠীর মানুষের সাথে বেঈমানী করে ওই রাজাকারের মুরীদ হয়ে তার এই ইচ্ছা পূরণ করেন। স্বরূপকাঠীর মানুষ এখনো নেছারাবাদ নামকে মেনে নিতে পারেনি।
তাই এখনো তারা অফলাইনের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও মানে ‘স্বরূপকাঠি’ নামের ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে তারা নেছারাবাদ নামের বদলে স্বরুপকাঠি নামের জন্য আন্দোলন ও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে ‘ধর্মের কল’ থাকায় রাজাকারদের বিরুদ্ধেও কোনো সরকার অ্যাকশন নিয়ে স্বরুপকাঠিবাসীর প্রাণের দাবী পূরণে এগিয়ে আসতে পারেনি! দু:খজনক হলেও সত্যি যে, এটাকেই আমরা আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে করুণ অবস্থার বহি:প্রকাশ হিসেবে ধরে নিতে পারি।
এছাড়া অতীত, ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক আরো কিছু জনপদ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে, সেদিকে কোনো সরকারেরই খেয়াল ছিলো না, এখনো নেই। এর অনেকগুলোর মধ্যে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ), এবং ভাওয়াল/জয়দেবপুর (গাজীপুর), ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ অন্যতম।
স্বাধীন বাংলার সাবেক রাজধানী হিসেবে বিক্রমপুর একটি ঐতিহাসিক এলাকা, এবং সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চল তার বৌদ্ধ জ্ঞান চর্চার জন্য এবং পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক প্রভাবের জন্য সুপরিচিত। বিক্রমপুরের এই রাজোচিত পরিবেশই কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও শিল্প সাহিত্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
এমনকি বাংলার বাইরেও এই সাংস্কৃতিক সভ্যতার ধারা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু জেলা বিভক্তির সুবাদে বিক্রমপুর থেকে মুন্সিগঞ্জে পরিবর্তিত হয়ে এক সময়ের সেই গৌরবের রাজধানী এখন অতীতের নিরব সাক্ষী মাত্র।
অথচ মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, জেলা হোক বা মহকুমা হোক তিনি এই জায়গার নাম বিক্রমপুর করবেন। জাতির পিতার এই শেষ ইচ্ছা সত্ত্বেও তার মৃত্যুর পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এই জেলার নাম ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করে মুন্সীগঞ্জ করে।
অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে গাজীপুর মহকুমা এবং পরবর্তীতে জেলা হিসেবে উন্নীত হওয়ার আগে এলাকাটির নাম ছিল জয়দেবপুর। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ এখানেই সংঘটিত হয়েছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকিস্তানি দখলদার বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির পক্ষ থেকে সেদিনই প্রথম গর্জে উঠেছিল বন্দুক। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার সুযোগ্য সহযোদ্ধা তাজউদ্দিন আহমেদ এই অঞ্চলের সন্তান।
অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক এ স্থানটির নাম পরিবর্তন করে ফেললেও এখানে কারো নজর নেই! এছাড়া শুধু ‘হিন্দুয়ানী নাম’ থাকায় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নারায়ণগঞ্জকে ‘না.গঞ্জ’ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘বি.বাড়ীয়া’ বলে অভিহিত করলেও সরকার এগুলো থামাতে ব্যর্থ।
অথচ পৃথিবীর সব দেশেই শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশের স্বার্থে নামকরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তবে ‘জিয়ানগরের’ নাম এখন সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পরিবর্তনের এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলেও এর শুরুটা করেছিলেন খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপি, জামায়াতের জোট সরকার যেভাবে ২০০২ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমানের নামে ‘ইন্দুরকানি’র নাম জিয়ানগর করেছিলো, এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই জিয়ানগরের নাম পরিবর্তন করেছে। তবে এর আগেও এই নাম বদলের আরেকটা যুক্তি আওয়ামী লীগের সরকার দিয়েছে, আর সেটা হলো ‘অবৈধ স্বৈরশাসকদের নামে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকা উচিত নয়’ আদালতের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থাপনা থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলার এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অবশ্য দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থান কিংবা স্থাপনার নাম পরিবর্তনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিগত বিএনপি জামায়াতের জোট সরকারের সময় তারা দেশের বৃহত্তম ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’র নাম বদলে যমুনা সেতু নাম দেয়। একইভাবে কক্সবাজার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ও বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের নাম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র করা হয়।
এছাড়া শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ নাসেরসহ ১৫ আগস্টে নিহত কয়েকজনের নামে করা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকেও তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নাম পরিবর্তন করে ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, শেখ কামাল স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে গোপালগঞ্জ স্টেডিয়াম করা হয়।
একদিকে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াতের আমলে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনের নাম শহীদ জিয়া মিলনায়তন, চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কক্সবাজার জাগীরঘোনা মসজিদ সড়কের নাম বেগম খালেদা জিয়া সড়ক, ফেনী ফুলগাজী মহিলা কলেজের নাম বেগম খালেদা জিয়া মহিলা কলেজ করে।
এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী এম এ হান্নানের নামে করা চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এম এ হান্নানের নাম বাদ দিয়ে এর নামকরণ করে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ওই সময় জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসৈনিক ও ভাষাশহীদদের নামে করা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকেও তাদের নাম বাদ দেয় বিএনপি, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার।
অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত সরকারের চোখের কাঁটা হলেও এদিক দিয়ে তাদের দেখানো পথেই হেঁটেছে আওয়ামী লীগ। গত জোট সরকার এ রকম শতাধিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, যান ও সরঞ্জামের নাম পরিবর্তন করেছে। সব ক’টির আগের নাম পুনর্বহাল করা হয়েছে।
তবে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বিএনপির পলিসি’র প্রয়োগ করেছে আওয়ামী লীগ। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নানের নামের বদলে বিএনপি সুফি সাধক শাহ আমানতের নাম দিয়েছিলো, যাতে এ সরকার নাম পরিবর্তন করলে তাদের সঙ্গে ধর্মের খেল খেলা যায়!
আওয়ামী লীগ এখানে সুফী সাধক শাহ আমানতের নাম পরিবর্তন না করে ২০১০ সালে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামও একইভাবে হযরত শাহ জালালের নামে পরিবর্তন করলো, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় এসেও এই নাম পরিবর্তন করতে না পারে। আর চালে ভুল করে পরিবর্তন করলেও যাতে বিএনপির সঙ্গে একই খেল খেলা যায়!
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘বিএনপিকে শিক্ষা দিতে এ নাম বদল’ হলেও এতে প্রায় শতকোটি টাকার অপচয় হয়েছে! এ প্রসঙ্গে তখন সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করায় জিয়া বা বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না।
ক্ষতি হবে বর্তমান সরকারের। কারণ, এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার কী পরিমাণ প্রতিহিংসাপরায়ণ, তা প্রকাশ করেছে। সুতরাং দুই সরকারের রেষারেষিতে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকার অপচয়টুকু ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই হয়নি!
নামকরণের এ বিষয়টা যে এখনকার কিংবা এর আগের বিএনপি, জামায়াতের জোট সরকারের সময়ই শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগেও ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আর স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন হয়ে বাংলাদেশ হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। পরে বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে ‘মুজিবনগর’ রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপকভাবে নামকরণ ও নামবদল করা হয়। তবে তখনকার এই পরিবর্তনের বেশিরভাগই স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে মিল রেখে হতো, যেটা এখন অনেকটাই অনুপস্থিত।
এছাড়া সারাবিশ্ব যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে আমরা পড়ে আছি নামকরণের গবেষণা নিয়ে। দেশের একমাত্র নভোথিয়েটারটির নাম এ পর্যন্ত চারবার বদল করা হয়েছে। এর বর্তমান নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার’। ১৯৯৫ সালে বিএনপি’র সরকার যখন ৫২ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি শুরু করে, তখন এর নাম ছিলো ‘ঢাকা নভো থিয়েটার’।
২০০১ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার কিছু দিন ঢাকা নভোথিয়েটার নাম পাল্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে রাখে। পরে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় গিয়ে মূল নাম ‘ঢাকা নভোথিয়েটার’ ফিরে যায়। এর কিছুদিন পরেই এ নামটি পাল্টে মাওলানা ভাসানীর নামে রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক একটি একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম রাখা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ফুটবল’। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই এ কাপের খেলা চালু হয়। আর বিএনপি আসলেই বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাই নয় এ সরকারের সময় দেশের রাজধানীর নাম পাল্টে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। এজন্য একশ্রেণীর স্তাবকরা ‘বঙ্গবন্ধু সিটি’, ‘শেখ মুজিব সিটি’ বা ‘মুজিবনগর’ করার প্রস্তাব করছে। সাবেক সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মুসা একজন সিনিয়র মন্ত্রীর উপস্থিতিতে রাজধানীর নাম পাল্টে ‘শেখ মুজিব সিটি’ করার দাবি জানিয়েছিলেন!
পৃথিবীর বিভিন্ন বিভিন্ন দেশে শিল্প, সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার এবং দেশ মাতৃকার জন্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন জায়গা ও স্থাপনার নামকরণ হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশে শুধু রাজনৈতিক কারণে এমন লোকের নামেও নামকরণ হচ্ছে যাদের কোনো যোগ্যতা এবং দেশমাতৃকার জন্য কোনো অবদান নেই।
এমনকি কোনো ব্যক্তি জীবিত থাকতেই তার নামেও নামকরণ হচ্ছে। অথচ বিদেশে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার নামে নামকরণ হয়। বহু বছর ধরে এই নাম টিকে থাকে এবং ক্ষমতাসীন কোনো দলই এই নাম পরিবর্তন করে না। বেশি দূরে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে ভারত স্বাধীন হওয়ার ৬৬ বছরে কোনো নামকরণ পরিবর্তন হয়নি।
এক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একটি ব্যতিক্রমী দেশ, যেখানে দেশের জন্য কাজের বদলে ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নামকরণ, নামবদলের কাজে ব্যস্ত থাকে!
সবশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নাম পরিবর্তনের পুরনো পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার মূলত: জনগণের কাছে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এই প্রতিহিংসার রাজনীতি মানুষ এখন আর পছন্দ করে না। এ ধরনের কাজ বিএনপি, জামায়াতের জোট সরকার করেছিলো বলেই জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
নাম পরিবর্তনের একান্ত প্রয়োজন হলে শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশের স্বার্থেই এর নামকরণ করতে হবে। বিগত সরকার কুকর্ম করেছে বলে বর্তমান সরকারকেও সেই একই পথ অনুসরণ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এ সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। সুশাসন ও কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে সরকারের উচিত নিজের ভাবমূর্তি
জনসাধারণের কাছে অক্ষুণ্ন রাখা। নামকরণ ও নাম বদলের এই অশুভ সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে শিল্প, সস্কৃতির বিকাশে এর ব্যবহার হওয়া প্রয়োজন। কারণ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভালো কাজের মাধ্যমে দেশ মাতৃকাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে না পারলে নামে কী আসে যায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)