সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে কখনই রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। ছিলেন পুরোদস্তর সফল এক ব্যবসায়ী। তবে ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠার আগেই সুদর্শন, আধুনিক এই মানুষটি সাধারণের কাছে বড় বেশি পরিচিত ছিলেন একজন সফল টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে। ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে উচ্চতায় নেওয়ার পর তিনি ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই-এরও নেতৃত্ব দেন। আনিসুল হক জনপ্রতিনিধির কাতারে আসবেন এটি বোধ হয় কারো কল্পনাতেই ছিল না। কিন্তু সর্বশেষ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হককে মেয়র পদে দলীয় সমর্থন দিয়ে নতুন এক চমক তৈরি করেন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল আনিসুল হক মেয়র পদে জয়ী হয়ে ৬ মে শপথ নেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময়ই তিনি বুঝিয়ে দেন গতানুগতিক ধারায় তিনি কাজ করবেন না। জনগণের স্বার্থে কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে মাথাও নত করবেন না। প্রতিশ্রুতিমতো নগরকে সুন্দর করতে, আমূল পাল্টে দিতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি কাজ করবেন। ২০১৫ সালের ৬ মে শপথ নেওয়ার পর থেকে তিনি সেভাবেই দুর্বার গতিতে চলতে থাকেন। সেই ধারায় অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সত্যিই এক ধরনের পরিবর্তন তিনি আনতে সক্ষম হন। পরিবর্তনটা তার মাথায় কাজ করতো সবসময়ই।
২০১৫ সালের ৯ নভেম্বরের কথা। সকালে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয়ের উদ্যোগে নগর দরিদ্র জীবনমান উন্নয়নে একটি গণশুনানীর আয়োজন করা হয় ডিএফআইডির সিঁড়ি প্রকল্পের আওতায়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক আর বিশেষ অতিথি জাসদ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক ছাত্রনেতা নাজমুল হক প্রধান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আনিসুল হক বেশ আগেই চলে আসেন মিলনায়তনে। সভা শুরু হতে বেশ দেরি। একটা টেবিলে বসে উনি আমাদের সাথে আড্ডার ছলে কথা বলতে শুরু করলেন নগরের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। নিজেই আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ঢাকা শহরে কী কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় যে আগামী ছয় মাসে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা পরিবর্তনটা দেখাতে পারবো। এরকম আইডিয়া বা প্রস্তাব আমাকে দিন, টাকা বা ফান্ড নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি পরিবর্তনটা দেখাতে চাই। চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি কথাগুলো বলে চললেন। আমরা কিছু সমস্যা এবং সেই সাথে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা তাৎক্ষণিক তুলে ধরলাম। নগর দরিদ্রদের যাপিতজীবন কীভাবে নিরাপদ ও উন্নত করা যায় এ বিষয়েও কিছু কথা বললাম। আনিসুল হক দৃঢ়তার সাথেই বলতে থাকলেন, ‘আমি হকার রাখতে চাই, আবার ফুটপাথও রাখতে চাই। জীবিকার জন্যে যে মানুষটি রাস্তায় রাস্তায় ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করে তাকেও রাখতে চাই- আইডিয়া দিন। এমন প্রস্তাবনা বা আইডিয়া দেবেন যে, তিন বা ছয় মাসের মধ্যে যেনো কাজটি করার পর পরিবর্তনটা চোখে পড়ে।’ আসলেই আনিসুল হক পরিবর্তনটাই কেবল চেয়েছিলেন। বদলে দিতে চেয়েছিলেন ঢাকা শহরটাকে।
কথায় নয়, দারুণভাবে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আর তাই শপথ নেওয়ার পর থেকেই তিনি কাজের মধ্যে ডুবেছিলেন। রাতদিন জনগণের কাতারে থেকে কাজ করতে চেয়েছেন। কখনই থেমে থাকেননি। অযথা সময় নষ্ট করেননি। আনিসুল হক মেয়র হবার পর থেকেই দেখেছি সর্বত্র পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। কয়েকটি চোখে দেখা উদাহরণ দিই। মোহাম্মদপুরে যে একাধিক খেলার মাঠ এবং পার্ক ছিল সেখানে কেউ যেতে পারতো না। সত্যিই উনি শপথ নেওয়ার পরদিনই আমরা সকালে দেখতে পেলাম তাজমহল রোডে যে পার্কটি আছে সেখানে যে ময়লার স্তুপ ছিল সেগুলো নেওয়ার জন্য ট্রাক এসেছে। সাতদিনের মধ্যেই পার্কটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। সেই পার্কে এখন প্রতিদিন সকালে অনেক মানুষের আনাগোনা। শুধু ঐ একটি পার্ক নয়, সবগুলো পার্কেই এখন সকাল সন্ধ্যায় মানুষের আনাগোনা।
ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট একসময় মানুষের প্রসাবে সয়লাব হয়ে যেত। বিশেষ করে উত্তরের ফার্মগেট, তেজগাঁও, গাবতলি এলাকাতে এটি ছিল নিত্য দৃশ্য। প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম করার কোনো সুযোগই ছিল না। আনিসুল হক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জনগণের এই চাহিদাটি খুবই পরিকল্পিতভাবে সমাধান করেন। অনেকই এখন ঠাট্টা করে বলেন ঢাকা শহরের পাবলিক টয়লেটগুলো বাসা বাড়ির চেয়েও সুন্দর। আসলেই তাই পাবলিক টয়লেটগুলো যেনতেন ভাবে তৈরি করেননি, সেখানে গোসল থেকে শুরু করে নামাজ পড়ার সুযোগ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। প্রতিটি পাবলিক টয়লেটে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই শুধুমাত্র তার আন্তরিকতার কারণেই এখন নগরীতে চমৎকার পাবলিক টয়লেটগুলো মানুষ ব্যবহার করতে পারছে।
বাসা বাড়ির সামনে, দুই বাসার মাঝখনের প্যাসেজে ময়লা জমিয়ে রাখা ঢাকাবাসীর পুরনো অভ্যাস। মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ, নুরজাহান, শেরশাহ, রাজিয়া সুলতানা, তাজমহল, হুমাযুন রোডে এই চিত্রটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। আনিসুল হক এসেই নির্দেশ দেন প্যাসেজগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদুপরের প্যাসেজগুলো থেকে টনকে টন ময়লা বের করা হয়। এখনও এই কাজ চলমান রয়েছে। এর আগে কোনো মেয়রের আমলেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। মনে আছে প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় মোহম্মদপুরের প্রতিটি মসজিদে খুতবার আগে মেয়র এবং কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে ইমাম সাহেব প্যাসেজে ময়লা না ফেলার জন্য অনুরোধ করতেন। মেয়র হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আনিসুল হক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। আর তাই দ্রুতই মোহম্মদপুর, গুলশান, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দ্রুত বর্জ্য ফেলানোর জন্য বেশ কয়েকটি এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন) গড়ে তোলেন। বিভিন্ন বাজারগুলোতে যে নোংরা পরিবেশ বিরাজমান ছিল যেসব জায়গাতেও তিনি অনেক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। আগে যত্রতত্র ময়লা ফেলার যে কুঅভ্যাস মানুষের গড়ে উঠেছিল সেটা তিনি সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছেন।
আনিসুল হক মেয়র হওয়ার আগে বৈধ-অবৈধভাবে বিলবোর্ডে সয়লাব ছিল ঢাকা শহর। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী আর পাতিনেতাদের বিশাল সিন্ডিকেট এই খাত থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিত। কিন্তু আনিসুল হক এসেই কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত না করে ঝুঁকিপূর্ণ সব অবৈধ বিলবোর্ড নামিয়ে নগরীর আকাশ মুক্ত করে দেন। এর আগে যারাই ক্ষমতায় ছিল তারা কেউই একটি অবৈধ বিলবোর্ডও নামানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। একইভাবে তিনি বাসস্ট্যান্ড এবং টার্মিনালগুলোতেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হোন। বিশেষ করে কারওয়ান বাজার সংলগ্ন তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড মুক্ত করাটা ছিল তার জন্য সবচেয়ে বড় এক চ্যালেঞ্জ। তেজগাঁও-এর রেলওয়ের প্রায় ৪০ একর জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে তুলেছিল স্থানীয় নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপ। আনিসুল সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ট্রাক স্ট্যান্ড মুক্ত করেন। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডও সরিয়ে নিয়ে এলাকা যানজট মুক্ত করেন।
ফুটপাতে চলাচলের অধিকার ফিরিয়ে আনতেও তিনি নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। গুলশানে উচ্চবিত্তের চলাচল থেকে শুরু করে বছিলার নিম্নবিত্তের চলাচলের সব জায়গাতেই তিনি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ছুটে চলেছেন। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, জনগণের চলাচলের জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক এবং বিপনীবিতানের সামনে যারা ‘নো পার্কিং’, ‘নো পার্কিং’ লিখে রাস্তা দখল করে তাদের বিরুদ্ধেও তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। বলেছিলেন ঢাকা শহরে পাবলিকের কোনো রাস্তায় ‘নো পার্কিং’ লেখা দেখতে চাইনা। আবার ফুটপাথে গাড়ি, মটর সাইকেল যারা রাখেন তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। নিজেই বেশ কয়েকবার হাতেনাতে কয়েকজনকে ধরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে তুলে দেন।
সবারই মনে থাকার কথা মেয়র নির্বাচনের সময় তিনি যে ইশতেহার দিয়েছিলেন সেখানে মূল শ্লোগান ছিল- পরিচ্ছন্ন-সবুজ-আলোকিত মানবিক ঢাকা-এবার সমাধান যাত্রা। তিনি বলেছিলেন শহরের দুটি দিক থাকে, একটি হচ্ছে ফাংশনাল বা কার্যকরী অন্যটি হচ্ছে ভিজ্যুয়াল বা বাহ্যিক রূপ। কার্যকরী ব্যবস্থার দিক থেকে শহরে জাতীয় আদর্শাবলির প্রতিফলন থাকা দরকার। বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনার মূল দার্শনিক ভিত্তি মানবিক মূল্যবোধ হলেও, ঢাকা দিনে দিনে রুঢ় ও রুক্ষ হয়ে উঠেছে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় এই শহরের স্নিগ্ধতা, মমতা। অথচ মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই শহরের কর্মসংস্থান নীতি, গৃহসংস্থান নীতি, যানবাহন-যোগযোগ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বণ্টন পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিলো। আমরা বিশ্বাস করি, মুষ্টিমেয়র জন্য সুন্দর শহরের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানবিক শহর বানানোতেই ঢাকার ভবিষ্যত নিহিত। তিনি বলেছিলেন মেয়রের জন্যে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া ২৮টি কাজের জন্য সরকারের ৫৬টি সংস্থার দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এসবের সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন।
গত আড়াই বছরে ঢাকা সিটির উত্তরাংশে যে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে সেটা আগে ছিল না। আর তাই আনিসুল হকের চিরবিদায় মানুষকে নাড়া না দিয়ে পারেনি। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সামান্য দিনে তিনি জনগণের হৃদয় মন্দিরে যেভাবে জায়গা করে নেন এটি বিরলই বটে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক বিপ্লবী আনিসুল হকের কিছু কিছু সমালোচনা করছেন। এটি সত্য, আনিসুল হক সমালোচনার উর্ধ্বে যেমন নন, আবার তিনি মহামানবও নন। তবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের কল্যাণে তার আত্মনিবেদনে কোনো ভণ্ডামি বা প্রতারণা ছিল না। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন এই নগরের মানুষকে সকল ধরনের দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করতে। তার ইচ্ছেটা প্রস্ফুটিত ছিল প্রকাশ্যেই। মৃত্যুর আগে স্বল্পসময়ে তিনি যা করেছেন, যতোটা পেরেছেন সেটাই সত্য উদাহরণ হয়ে থাকবে, যতক্ষণ না আর কেউ তার মতো হয়ে আসবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)