রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মায়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের চাপ অব্যাহত রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের যেন তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের তো দেশে ফিরে যেতে হবে। তবে চাপ থাকলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সরকার। যেহেতু জাতিসংঘসহ বিশ্বের বড় বড় সংস্থাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না মায়ানমার সরকার, সেহেতু বিষয়টির সমাধান কিভাবে হবে তা তখনও সরকারের কাছে পরিষ্কার নয়। আর প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে বিএনপি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফিরিস্তি গেয়ে চলেছে তখনও।
মাত্র ১ লাখ শরণার্থী আশ্রয় দিতে ইউরোপ সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া দিয়েছিল। অথচ মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়, সেবা ও খাদ্য সরবরাহ করছে। ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, সে সময়ে ভারত সরকার এদেশের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তি সময়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারীরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। তাই রোহিঙ্গাদেরও তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে সরকার।
ঘটনার প্রথম দিকে রাখাইন পরিস্থিতির ভয়াবহতা কেউই আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু পালিয়ে আসা শরণার্থীরা ঢল, নির্যাতন বিষয়ে তাদের বর্ণনা এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কল্পনাতীত সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে সর্তক করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই এত শরণার্থী প্রবেশ করে যে, হঠাৎ শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তা ছাড়া প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয়, বাসস্থান-স্যানিটেশন ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতার সুযোগে রোহিঙ্গারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
সংকটের সমধান কিভাবে করা যায় এ বিষয়ে তখন জোর আলাচনা চলছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ১৮ সেপ্টেম্বর সোমবার কলকাতার আইসিসিআরের সত্যজিৎ রায় মিলনায়তনে ‘আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মানবিক সংকট হিসেবে দেখা দিলেও এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে এদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের যোগ সম্পর্কে সরকারের কিছু জানা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গাদের সাথে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি-চেহারা ইত্যাদির মিল থাকায় তারা অতি সহজেই কক্সবাজার ছেড়ে বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছেন। যা দেশের জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে বলে মন্তব্য করে এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তারা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার যাশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে দুই পরিবারের মোট ৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। ওইদিন বিকেলেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার সময় আরও চার রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। ওইদিন রাতে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম তিন রোহিঙ্গা পরিবারের ২০ জনকে আটক করে পুলিশ।
এ ছাড়া গত ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার হবিগঞ্জের মাধবপুরের শাহজিবাজার ট্রেন স্টেশন থেকে সাইফুল ইসলাম নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে কক্সবাজারে ফেরত পাঠায় পুলিশ। গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়, ২৫ আগস্ট থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত দিয়ে পাহাড়ি পথে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজলোয় অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে রাউজান, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, পটিয়া, বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছেন।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গারা যাতে কক্সবাজারের বাইরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর প্রবেশমুখেও একাধিক তল্লাশি চৌকি বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তা ছাড়া কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী বিভিন্ন বাসে তল্লাশি চালিয়ে আটক রোহিঙ্গাদের টেকনাফে ফেরত পাঠানো হয়। তা ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী নির্দিষ্ট শিবিরের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে আইন অনুযায়ী অবৈধ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবেন এমন ঘোষণা দেয় পুলিশ।
১৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দফতর এ ঘোষণা দেয়। কথা হয় পুলিশের একজন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে। তিনি জানান, রোহিঙ্গারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে হয়তো এ দেশের নাগরিক হতে চাইবে, নয়তো কাজ করার চেষ্টা করবে। তারা হয়তো কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়বে কিংবা কোনো প্রতারক চক্রের মাধ্যমে অপরাধের শিকার হবেন। রোহিঙ্গারা দেখতে আমাদের মতো হলেও ভাষাগত দিকে এক নয়, তাই ছড়িয়ে গেলে ধরা পড়বেই। বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে আশ্রয় নিলে যেভাবে গণ্য করা হয়, তাদেরকেও তখন সেভাবে গণ্য করা হবে।
তবে প্রচলিত আইনে শরণার্থী শিবিরের বাইরে পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানোর কথা বলা হলেও মানবিক দিক বিবেচনায় তাকে আদালতে না পাঠিয়ে উদ্ধার করে নির্দিষ্ট শিবিরে পাঠানো হবে। এদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়লে তা দেশের সামজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক এমনকি নিরাপত্তগত মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে দেন বিশেষজ্ঞরা।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, রোহিঙ্গারা প্রাথমিকভাবে খাবার ও আশ্রয়ের অভাবেই মূলত শিবিরের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া সুযোগসন্ধানী ও পাচারকারীরাও তৎপর রয়েছে। কিন্তু বড় বিষয় হচ্ছে এসব রোহিঙ্গারা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়লে কিছুদিনের মধ্যেই তারা কাজের খোঁজে বের হবে। এতে একদিকে যেমন এ দেশীয়দের সাথে তাদের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে, একইসঙ্গে সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার হুমকিও হয়ে উঠতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, দেশ এমনিতেই উগ্রপন্থার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এমন সময়ে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থে এদের ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তবে তা ভয়াবহ হবে। রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়লে দেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে বলে একমত পোষণ করে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার নির্দেশ দিয়েছে যেন রোহিঙ্গারা শরণার্থী শিবিরের বাইরে দেশে অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। তবে দুর্নীতি অর্থাৎ টাকা-পয়সা দিয়ে তারা যদি ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসে, তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা কর্মসংস্থানে ভাগ বসাবে। তা ছাড়া বাইরে গিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
নির্যাতিত মানুষ সহজেই উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে মন্তব্য করে ডক্টর বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে কোনো উপায়ে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ক্যাম্পেই রাখতে হবে। তা না হলে রোহিঙ্গা যুবকেরা উগ্রপন্থী সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। আর সেটা হলে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি গভীর সংকটে পরিণত হবে।
নিখোঁজ রোহিঙ্গাদের খুঁজে বের করতে উদ্যোগ: যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের অনেকেই জানেন না তাদের পরিবারের বাকি সদস্যের কথা। যারা চোখের সামনে মারা গেছে তাদের বিষয় আলাদা। অন্তত পক্ষে তারা যে আর ফিরে আসবে না এ বিষয়টি নিশ্চিত রোহিঙ্গা পরিবারের বাকি সদস্যরা। তবে যে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর বাকি সদস্য বেঁচে আছে, তবে তারা কোথায় আছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক।
এমনও ছোট শিশু দেখেছি, একটি দলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ চলে এসেছে। তবে তার পরিবারের বাকি সদস্যের একজন বেঁচে থাকলেও তার খবর সে জানেনা। পরিচয় হয় রহমান নামের এক যুবকের সাথে। সে জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন তাদের গ্রামে হামলা চালায় তখন সে একদিকে আর তার ছেলে আরেক দিক দৌড় দেয়। এরপর থেকে তাদের আর যোগাযোগ হয়নি। সে জানে না তার ছেলে বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে।
এ কারণে নিখোঁজ রোহিঙ্গাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বুথ চালু করে কামাল নামের একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। দেখা যায়, একটি মঞ্চ বানিয়ে নিখোঁজ রোহিঙ্গা শিশুদের বিষয়ে মাইকিং করছেন কামাল। তিনি জানান, ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২৯টি শিশুকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বুথ। অনেক রোহিঙ্গাই এ বুথের কাছে এসে নিখোঁজ সন্তানের সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছেন তখন। ( চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)