চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দেশ কাঁপানো খালেদ মোশাররফের সেই ৪ দিন

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসা খন্দকার মোশতাক আর খুনি মেজরদের ৮১ দিনের অবৈধ শাসনের অবসান ঘটিয়ে খুনিদের মদদে সেনাপ্রধানের আসনে বসা জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন খালেদ মোশাররফ। তবে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সফল এই নায়ক অভ্যুত্থানের পর সবদিক গুছিয়ে উঠতে পারেননি।

তিনি সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফেরাতে চাইলেও জিয়ার অনুসারী সেনা এবং কর্নেল তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা অভ্যুত্থানের দিন থেকেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিনা রক্তপাতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের মাত্র ৪ দিনের মাথায় ৭ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের রক্তঝরা অধ্যায়ের সূচনা দেখে বাংলাদেশ।

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রমের লেখা ‘দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা’ বইতে লেখা হয়েছে, ‘অভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে খালেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কোনো মানসিক প্রস্তুতি এমনকি পরিকল্পনা ছিলো না। এ কারণে এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অফিসারেরাও করণীয় সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলো।’

ওই সময়ের বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক বইগুলো পড়লে বোঝা যায় ১৫ আগস্টের পর ৩ নভেম্বর পাল্টা ক্যু করে খালেদ মোশাররফ মোশতাককে অপসারণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে একটি পদত্যাগপত্র আদায় করতে পারলেও পুরো সেনাবাহিনীর ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।


ঢাকা স্টেশন কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল এ অভ্যুত্থানের মূল দায়িত্বে থাকলেও সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটগুলো তার নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। ঢাকার সেনা কর্মকর্তা এবং সৈনিকদের ওপর আস্থা কম থাকায় রংপুর ব্রিগেড থেকে দুই ব্যাটেলিয়ন এবং কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র কয়েকদিনের মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। তার ডাকে সাড়া দিয়ে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন কর্নেল হুদা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

৩ নভেম্বর একদিকে যখন সেনানিবাসে অভ্যুত্থান করে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হচ্ছিলো, তখন সেই রাতেই অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও ফারুক চক্রের নির্দেশে একদল সেনাসদস্য জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন তার লেখা ‘গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী খালেদ মোশাররফ ও অভ্যুত্থানকারীরা ৪ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ডের খবর পায় ।

খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের পর খুনি মেজরদের পুতুল, মোশতাক সরকারকে অপসারণ করে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড নিয়ে আসা এবং সংবিধান সমুন্নত রাখতে আলোচনা শুরু হয় বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান ওই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘৩ নভেম্বর সকালে আমরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলাম। সেদিন থেকেই মোশতাক ও তাকে মদদ দেয়া সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসি আমরা। সব নিয়ম মেনে মোশতাক যেনো পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে এটাই চেয়েছিলাম আমরা। কারণ আমরা চাইনি আমাদের অভ্যুত্থানকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের ক্ষমতাদখলের চেষ্টা হিসেবে দেখা হোক। বঙ্গভবনের ট্যাংকগুলোকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার শর্ত দিয়েছিলাম।’

মোশতাক অভ্যুত্থানকারীদের এসব প্রস্তাব নিয়ে সময়ক্ষেপণ করছিলেন। তখন এর কারণ বোঝা না গেলেও ৭ নভেম্বরের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর সব স্পষ্ট হয়ে যায় জানিয়ে মেজর (অব). নাসির বলেন, ‘মোশতাক প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে ৪ তারিখ রাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন তিনি।’

৪ নভেম্বর রাতে জারি করা দু’টি আদেশে খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ দেয়া হয় এবং জেলহত্যার বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করা হয়।

৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় অভ্যুত্থানকারীরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সন্ধ্যায় তখনকার সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ, বিমান বাহিনী প্রধান এম জে তাওয়াব এবং নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খান বিচারপতি সায়েমের বাসায় গিয়েছিলেন। প্রথমে শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও একটু পরেই তিনি বলেছিলেন “আলহামদুল্লিাহ” ।


এই ঘটনার বিবরণ আছে শাফায়েত জামিলের লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইটিতে ।

৬ নভেম্বর সারাদিন বঙ্গভবনেই ব্যস্ত ছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম যখন শপথ নিচ্ছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন গৃহবন্দী, তখন কিন্তু সবচেয়ে সক্রিয় জাসদের গণবাহিনী এবং সৈনিক সংস্থা ।

এরকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে এরকম কথা খালেদ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী সেনাদের কানেও এসেছিলো।

পাল্টা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কথা শোনা যাচ্ছিলো জানিয়ে মেজর (অব.) নাসির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘মোশতাক সরতে রাজি হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমকে রাজি করাই আমরা। ৫ তারিখেই খবর পাই সেনানিবাসগুলোতে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ভারত-রাশিয়ার মদদে সেনা বিদ্রোহ হিসেবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, লিফলেট বিলি করা হচ্ছে।’

এরকম অপপ্রচারে ভর করে ৬ নভেম্বর রাত থেকে ঘনিয়ে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়।

কর্নেল শাফায়াত জামিলের বই থেকে জানা যায় যে ৬ নভেম্বর বিকেলেই ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ সেনানিবাসে উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়ায়। ওই রাতে আবারো বঙ্গভবন যান খালেদ মোশাররফ। শাফায়াত জামিলও যান আলাদাভাবে।

কর্নেল তাহেরের ভাই ড. মো. আনোয়ার হোসেন তার বইতে লিখেছেন: ‘৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ইউসুফ ভাইয়ের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দিকের গুলশানের বাড়িতে সিপাহী-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের অপারেশনাল পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।’

নিজের বইতে শাফায়াত জামিল লিখেছেন, “রাত ১০টার দিকে খালেদ মোশাররফের ফোন পেলাম। ফোনে তিনি আমাকে বঙ্গভবন যেতে বললেন। গাড়ীতে উঠছি, তখন ব্রিগেড মেজর হাফিজ আমাকে বললো, স্যার একটা জরুরী কথা আছে।”

সে সময় মেজর হাফিজ শাফায়াত জামিলকে জানিয়েছিলেন রাতেই সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটি করবে। একজন সুবেদার মেজর হাফিজকে একথাও বলেছিলেন যে তিনি এ কথাও শুনেছেন যে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলকে মেরে ফেলা হবে।

পরে বঙ্গভবনেই শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফকে সেনানিবাসের কথা জানিয়েছিলেন। রাত বারোটার দিকে ‘সিপাইদের বিপ্লব’ শুরুর কথা ফোনেই জেনেছিলেন শাফায়াত জামিল। কিন্তু তখন আর কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল না তাদের। ওই রাতেই তাহেরের সৈনিক সংস্থা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।

এরপর রাত তিনটার দিকে জিয়া টেলিফোনে বঙ্গভবনে কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে কথা বলেন। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন “Forgive and forget, let’s unite the Army.” অথচ ৭ নভেম্বর সকালে নিহত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও মেজর হায়দার।