চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দৃষ্টির ধর্ষণ থেকে মুক্তি কবে?

‘হ্যালো ফ্রেন্ডস, নায়লা নাইম কখনও ব্ল্যাফ দেয়না। সি, আই এম হেয়ার। একদম রেডি। সো কাউন্টডাউন স্টার্ট কর’। স্তন ক্যান্সার সচেতনতা বাড়াতে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার নির্মিত এক স্বল্পদৈর্ঘ্য অনলাইনকেন্দ্রিক যৌন আহবানমূলক একক নাটকে এভাবেই উপস্থাপন করা হয় তথাকথিত মডেল নায়লা নাইমকে। নাটকের বাকি ডায়লগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মোটামুটি অনেকেই জেনেছে বা দেখেছে। এটিকে নাটক কেন বলছি? বিজ্ঞাপন বলতে আমরা বুঝি, এটি একটি উপায় যার মাধ্যমে নতুন কিছুর আগমন বার্তা জানানো হয়। শুধু তাই নয় পুরোনো বা এরই মধ্যে বাজারে চালু পণ্য বা সেবার নতুন গ্রাহক তৈরির কৌশল হচ্ছে বিজ্ঞাপন। পণ্যের প্রচার ছাড়া সামাজিক সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনও রয়েছে। সরকার বা যেকোন সংস্থা কোন বিশেষ সময়ে বা বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন। এখানেও বিজ্ঞাপনী সংস্থার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল সেটি আমি বলতে পারবোনা। কিন্তু আমাদের চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা স্তন ক্যান্সারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যৌনতাকে পাশ কাটাতে পারেনি অথবা বলতে পারি নির্মাতাদের রুচির দৈনতার প্রকাশ ঘটেছে। এই বিজ্ঞাপনটি কাদের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটা এখানে স্পষ্ট নয়। স্তন ক্যান্সার বিষয়ে এখনও আমাদের দেশের নারীরা যেখানে অন্ধকারে, সেখানে নায়লা নাইমের চেকমেট হবার আহবান এবং শুরুতে তার ব্ল্যাফ না দেয়ার কথাগুলো কি স্তন ক্যান্সার সচেতনায় ভূমিকা রেখেছে? নাকি কোন নারী এটিকে সচেতন বার্তা হিসেবে নিয়েছে? পুরো বিষয়টি হাস্যরস ও যৌন আলোচনার খোরাক জোগানোর মতো একটি নাটক হয়েই রইল বিজ্ঞাপনটি।

এবারে আসছি একই বিষয় স্তন ক্যান্সার সচেতনতা নিয়েই ভারতের নির্মিত একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে। এক সময়ের পর্নস্টার এবং বর্তমান অভিনেত্রী সানি লিওনকে দিয়ে বানানো হয়েছে বিজ্ঞাপনটি। যেখানে সানি লিওন সেখানে খোলামেলা দৃশ্যই স্বাভাবিক। কিন্তু স্তন ক্যান্সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিজ্ঞাপনে সেই দেশের নির্মাতারা যথেষ্টই রুচির পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে চারজন ভিন্ন পেশা বা শ্রেণীর মানুষ যখন একটি মেয়ের সাথে কথা বলে তখন পুরুষটির চোখ আটকে থাকে মেয়েটির শরীরে। চমৎকারভাবে বিজ্ঞাপনে কোন নারীর উপস্থিতি নেই। পুরুষের দৃষ্টিতেই বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে তার দৃষ্টি সামনের নারীটির শরীরের দিকে। পরবর্তীতে সানি লিওন পর্দায় হাজির হয়ে বলেন, পুরুষরা যেভাবে মেয়েদের স্তনের দিকে মনোযোগ দেয় মেয়েরা যদি সেভাবে দিত তবে ব্রেস্ট ক্যান্সার অর্ধেক কমিয়ে ফেলা যেত। একই বিষয়, অথচ রুচি আর নির্মাণশৈলীর দক্ষতায় দুটি বিজ্ঞাপন দুভাবে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে মানুষের কাছে।

তবে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু বিজ্ঞাপন নয়। এই বিজ্ঞাপনের সাথে সম্পৃক্ত বলেই টেনে আনা হয়েছে। নারীর স্তন। তা কি কেবলই যৌনতা? উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে যেটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। নারী পুরুষের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রের ভিন্নতায় যৌনতা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষ নারীকে যেভাবে দেখে তা ওই বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট। আর প্রথম বর্ণিত বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপন নির্মাতারা সরাসরি নারীর শরীরকে এখানে অযাচিতভাবে তুলে এনেছেন।

অর্থাৎ একটিতে সরাসরি নির্মাতারা নারীর প্রতি তাদের মানসিক অবস্থান বুঝিয়েছেন, অন্যদিকে দ্বিতীয়টিতে নারী শরীরের প্রতি পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলেছেন। আর দ্বিতীয়টিতে নারীর প্রতি পুরুষের যে মানসিকতা দেখানো হয়েছে অসংখ্য মেয়ের প্রতিদিনের ঘটনা। যাকে আমরা ‘দর্শনে ধর্ষণ’ বলতে পারি। প্রতিটি মেয়ে এই ধর্ষণের শিকার সেই ছোট বয়স থেকেই। বাড়ির দারোয়ান, রিকশাচালক, সবজিওয়ালা, দোকানদার, পথচারী, বস, সহকর্মী, অধীনস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী, বন্ধু আবার কখনও কখনও খুব কাছের কোন পুরুষ দ্বারা এই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মেয়েরা। সদ্য কৈশোরে পা দেয়া কিশোরী থেকে শুরু করে বোরকা পরিহিতা নারী সকলেই এই মানসিক ধর্ষণের শিকার। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমার এই কথাগুলোকে অর্থহীন মনে হতে পারে। কারণ, বর্তমান সময়ে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি যে মহামারি আকার ধারণ করেছে সে তুলনায় এটি বড্ড তুচ্ছ মনে হতেই পারে। এটা কেউ দেখেনা। এমনকি পাশের ব্যক্তিটিও বুঝতে পারেনা কি হচ্ছে তার মেয়ে বা বোনটির সাথে। কেবল বুঝতে পারে নির্যাতনকারী আর নির্যাতিতা নারীটি। এই চাহনি যে কতটা কষ্টকর ও তিক্ত তা কেবল বুঝতে পারে সেই মেয়েটি। ধরে নিন, সদ্য কৈশোরে পা দেয়া মেয়েটির সাথে যদি এমন হয় আর তার সাথে মুখের অদ্ভূতভঙ্গি যোগ হয় সেই মেয়েটি কি এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলতে পারে? না বিচার চাইতে পারে? আর এভাবেই একসময় সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে কেবল মেয়ে হবার জন্য। কেউ কেউ এ সময় নিজেকে গুটিয়ে নেয় এবং অনেকে এই বয়সে বাড়ির নতুন অতিথি বা পরিচিত পুরুষ আত্মীয়ের সামনে যেতে চায়না। তখন থেকেই সে শুধু ঢেকে রাখতে চায় নিজেকে, শকুনের চোখ থেকে নিজেকে আগলে রাখতে চায়, আর কেউতো সারাজীবনের জন্য কুঁজো হয়ে হাঁটতে শিখে যায়। কিছুদিন আগেই পাড়ার ছেলেদের সাথে যে দৌঁড়ে বেড়িয়েছে, সে এই সময়ে এসে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। খেলাধুলাসহ তার অনেক ক্রিয়েটিভিটিই এ সময় এসে থমকে যায় অনেক মেয়ের। সঠিক পারিবারিক গাইডলাইন পেয়ে কেউ কেউ উৎরে বের হয়ে আসে এ অবস্থা থেকে।

কেন একে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানী বলছি? যৌন হয়রানী হচ্ছে এমন এক আচরণ যা মানুষের যৌনতাকে উদ্দেশ্য করে মানসিক ও শারিরীকভাবে করা হয়। পুরুষও যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে। তবে আমাদের দেশে নারীরাই বেশি এর শিকার। হয়রানির শিকার নারীর অনুভূতিই বলতে পারে বিষয়টি যৌন নির্যাতনের আওতায় পড়ে কীনা। নারী পুরুষ দুজন ব্যক্তির সম্পর্কের উপরও নির্ভর করে বিষয়টি যৌন হয়রানি কিনা। একই ঘটনা ভিন্ন ব্যক্তি ও সময়ের ব্যবধানে যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, শারিরীক ও মানসিক যে কোন ধরণের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে যৌন ইঙ্গিতপূণ মন্তব্য বা রসিকতা করা, গায়ে হাত দেয়া, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, এসএমএস, পর্নোগ্রাফি বা যে কোন ধরণের চিত্র, অশ্লীল ছবি, দেয়াল লিখন, অশালীন উক্তিসহ আপত্তিকর কোন ধরণের কিছু করা, কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলা, কোন নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যে কোন ধরণের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের দাবী বা অনুরোধ বা অন্য যেকোন শারিরীক বা ভাষাগত আচরণ, যার মধ্যে যৌন ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন।  আর এই বিবেচনায় পুরুষের চোখের নোংরা দৃষ্টির মাধ্যমে নারীকে মানসিকভাবে যৌন হয়রানি করা হয়, তাই এটি অবশ্যই যৌন হয়রানি ও ধর্ষনের আওতায় পড়ে।  কিন্তু নারীরা এর বিচার চাওয়াতো অনেক দূরের বিষয় কাউকে মুখেও বলতে পারেনা এ অসহ্য হয়রানির কথা। যা রাস্তাঘাটে, বাড়িতে বা অফিসে সবসময়ই তার সাথে হয়ে যাচ্ছে। নারীর এ হয়রানি থেকে মুক্তি কোথায়?  পুরুষের আচরণের পরিবর্তনই কেবল একটি মেয়েকে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।  যেখানে একটি চোখের অশুভ দৃষ্টির কারণে মেয়েটি কুঁকড়ে যাচ্ছে সেখানে হয়ত ছেলেটি বুঝতেই পারছেনা এটিও একটি যৌন হয়রানি।

একটি ছেলে শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেভাবেই নারীর প্রতি তার সহিংসতা বা সম্মানজনক মনোভাব আত্মস্থ হয়ে ওঠে। এক সময় তাতেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে আর পরবর্তী জীবনে সেভাবেই সে নারীর সাথে আচরণ করে। ঘরে বাবা, চাচা বা অন্য কোন পুরুষকে যদি নারীদের সাথে খারাপ আচরণ বা অবজ্ঞা বা অপমান করতে দেখে তবে সেও নারীদের অপমান করার মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকে। একসময় এটাই তার ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে যায়। পাশাপাশি মেয়েরা তার মা বা চাচীর প্রতি শত অত্যাচার অনাচারেও কথা না বলে মেনে নেয়ার বিষয়টি ধারণ করে। এভাবে ছেলে মেয়ে উভয়েই অপরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বড় হয়। পরবর্তী জীবনে কেউ হয় ভিলেন আর কেউ হয় ঘটনার শিকার। এ প্রবণতা থেকে ছেলে মেয়ে উভয়কেই রক্ষা করতে হলে প্রথমে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মেয়েকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ না করে ছেলেকেও শিক্ষা দিতে হবে বাইরের মেয়েদের সাথে কেমন আচরণ করবে। তার কোন আচরণটি মেয়েদের যৌন হয়রানির কারণ হয়ে ওঠবে, সে শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে। আর এভাবেই ছেলে মেয়ে উভয়েই উভয়ের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে শিখবে।

কিন্তু এখনও এদেশে বেশিরভাগ মানুষের মন্তব্য, মেয়েরা অশালীন পোশাক পরে বাইরে চলাচল করে বলেই হয়রানির ঘটনা ঘটে। আর আমাদের নারীরাও সেসব কথা আমলে নিয়ে নিজেকে যেন ঢেকে রাখার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু প্রশ্ন তাতেও কি থেমেছে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ? তনু তবে কি দোষ করেছিল?  আপাদমস্তক ঢেকে রাখা নারীর ক্ষেত্রে যৌন হযরানির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তবুও এতটুকু বদলায়নি পুরুষ বা নারীদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। বরং উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। উত্যক্তকারীদের না দোষ দিয়ে উল্টো মেয়েদের উপর দোষ চাপিয়ে তাকে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে তোলা হয়। অন্যদিকে অপরাধীরা দিগুণ উৎসাহে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। সমাজের চাপ ও পারিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে আইনের সাহায্য পেতেও সমস্যা হয় মেয়েদের। যদিও সম্মান যাবার কথা ছিল উত্ত্যক্তকারীর। বিকৃত মানসিকতার পুরুষেরা নিজেদের বিকৃত বিনোদন হাসিল করার জন্য নানাভাবে উত্যক্ত করে মেয়েদের। ভয়ভীতি ডিঙিয়ে মেয়েটি যখন সব কথা বলে তার পরিবারের কাছে, তখন পরিবার থেকেই আসে সবচেয়ে বড় বাধা। সমাজের কথা চিন্তা করে মেয়েটির জীবনকে ঠেলে দেয়া হয় এক দূর্বিষহ অন্ধকারে। আর তখনই ঘটে আত্মহননের মতো ঘটনা।

চোখের দৃষ্টিতে নারীকে প্রতিদিন হয়রানি করা হচ্ছে আর এ ঘটনা প্রতিদিন ঘটলেও নারীকে কেবল মেনে নিয়েই প্রতিদিন পথ চলতে হচ্ছে। যতদিন না পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন হবে ততদিন সব হয়রানির আলোচনায় আসলেও এ ঘটনাটি আলোচিতও হবেনা। পুরুষরা আজও নারীকে দেখে কেবল ভোগের বস্তু হিসেবে। আর এভাবেই দিনের পর দিন নারীকে করা হয় দুর্বল। অভিভাবকরাও সন্তানদের ভুল বিষয় ব্যাখ্যা দিয়ে আর নিজেরা ভুল ধারণা নিয়ে সমাজে বেঁচে আছেন। আমি বা আমরা কি আজ পর্যন্ত কোন অভিভাবককে তাদের ছেলে সন্তানকে বলতে শুনেছি যে মেয়েদের সাথে ভালো আচরণ করবে? বা কোন কোন বিষয় মেয়েদের জন্য হয়রানিমূলক সে সম্পর্কেও পরিবার থেকে কোন ধারণা দেয়া হয়না ছেলেদের। আর তাদের এই ভুল ধারণার মূল্য দিয়ে যাচ্ছে অসহায় মেয়েরা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)