স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখবার সময় তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম যেগুলোয় মূল্যবোধের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। যার মধ্যে নিহিত ছিল আমরা কেনো যুদ্ধ করছি, স্বাধীন হলে আমরা কী ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করবো? সেই তিনটি কথা ছিলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। আর দুটি কথা ছিলো সরকার সম্পর্কে যে আমরা ন্যায়ানুগ এবং নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠন করব।
এই পাঁচটি কথার উপরেই আমাদের সংবিধান প্রস্তুত করা হয়েছে যেখানে জনগণকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং একটি ন্যায়ানুগ গণতান্ত্রিক সরকারকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রপরিচালনার ভার দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার এই মূলনীতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়েছে সাম্যের প্রশ্নে।
সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং পঁয়তাল্লিশ বছরে একটি অসম সমাজকাঠামো বিন্যস্ত করা হয়েছে। অর্থবিত্তের মালিকানার ক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে সমাজে। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস গ্রাস করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের মূল যে শক্তির জায়গাটি ছিল মানবতাবাদ, সেখান থেকে আমরা সরে এসেছি। মানবিক মর্যাদার মূল কথাটি ছিল একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা।
সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ম্লান হতে চলেছে। কেবল ভিন্নমত পোষণের জন্য প্রাণহরণের মতো ঘটনাও আমরা ঘটতে দেখেছি। কাজেই এটা বলা যায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে মানবিক মর্যাদার কথা বলা হয়েছিল আমরা তাকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি। বরং সমাজে এমন একটি মানদণ্ড দাঁড়িয়ে গেছে যে, যে যতো বেশি অর্থবিত্তের মালিক সে ততো বেশি মর্যাদাবান।
অর্থবিত্ত কিংবা ক্ষমতার হিসেবনিকেষের বাইরে গিয়ে সকলকে মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারটি তাই অর্থবিত্ত ও পেশীশক্তির দৌরাত্ম্যের কাছে পরাজিত হয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বিচার সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগের উদাহরণ আমরা দেখছি না। এর পেছনের মূল কারণ হলো সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এর একটি অপরটির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত কাজেই কোনো একটি বা দুটিকে বাদ দিয়ে বাকিগুলো অর্জন সম্ভব নয়।
আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ এই বিষয়গুলো আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর মূল ভিত্তি হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা সর্বক্ষেত্রে এই মূলনীতিগুলো ধারণ করে চলতে পারিনি। দীর্ঘসময় এদেশে সামরিক শাসন ও পোষাকি গণতন্ত্র জারি ছিলো। রাষ্ট্র তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ মেনে চলতে পারেনি।
সংবিধানে বর্ণিত ছিল সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে, যার প্রতিফলন আমরা সবসময় দেখতে পাইনি। জাতীয়তাবাদের মৌল জায়গাগুলো বারংবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলে নেয়া প্রয়োজন আমাদের সমাজতন্ত্র রেজিমেন্টেড সমাজতন্ত্র ছিল না। আমাদের সমাজতন্ত্র ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সমাজতন্ত্র। বলা বাহুল্য সমাজতন্ত্রের ন্যূনতম রূপরেখাও আমরা অনুসরণ করতে পারিনি।
মহাকব্যিক মুক্তিযুদ্ধ, যা আমাদের জাতীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন এবং তার ফলস্বরূপ যে অনন্যসাধারণ সংবিধান আমরা অর্জন করেছিলাম তার মূলনীতিতে আমরা কেনো অটল থাকতে পারলাম না অথবা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়া কেনো সর্বাংশে সম্ভব হলো না সেটি দীর্ঘ বিতর্কের বিষয়। তবে এর পেছনে মূল কারণ নিঃসন্দেহে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি।
দুর্নীতি ও কালোটাকার দৌরাত্ম্য এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল একক কাঠামোকে জর্জরিত করে রেখেছে। বলা চলে দেশজুড়ে দুর্নীতির উৎসব চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ শক্তির আসীন হওয়া ও পরবর্তী দীর্ঘ সামরিক শাসন যেমন একদিকে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসকে আশ্রয়-প্রশ্রয় যুগিয়েছে অন্যদিকে দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসনের সর্বস্তরে।
এতে করে সাম্য স্থাপন প্রক্রিয়া মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে পাশাপাশি মানবিক মর্যাদার চরম অবমাননা হয়েছে। দুর্নীতি-কালোটাকা-সন্ত্রাস-মৌলবাদের চক্রব্যূহ আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে দিচ্ছে না। এর একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করে সন্ত্রাস ও মৌলবাদ দমন সম্ভব নয়। সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশেও বিস্তার লাভের সুযোগ পাচ্ছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে না ধরলে মুক্তিযুদ্ধের সুফল কখনোই ঘরে ঘরে পৌঁছানো যাবে না। মুক্তি শব্দটি নিছকই কিছু বিত্তশালী ব্যক্তির জন্য অর্থবহ শব্দগুচ্ছে পরিণত হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখন আরেকটি গণজাগরণ প্রয়োজন। এই জাগরণ একই সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাগরণ হতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে প্রণীত হওয়া প্রয়োজন যাতে শিশুবয়স থেকেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মৌল অর্থগুলো চেতনায় বিকশিত হতে পারে। তার জন্য তরুণ প্রজন্মকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি এক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উপর গুরুত্বারপ করছি।
অবশ্যই এর পাশাপাশি আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন হওয়া জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য নিকট ভবিষ্যতে আমি এমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পারছি না যার ফলে আমাদের রাজনৈতিক কাঠামোতে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন সংগঠিত হবে। এর অন্যতম একটি কারণ হলো আমাদের মেধাবী তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসছে না। বলা ভালো সেই উত্তরণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে ঘুরে ফিরে সত্তর আশির দশকে নেতৃত্ব দেয়া মানুষেরাই এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে রয়ে গেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে নতুন নেতৃত্বের সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে যার ফলে ছাত্ররা সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক পর্যায়ে অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছে না। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাও এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ, আমাদের সেদিকেও নজর দিতে হবে। আমি আশা করেছিলাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে এসে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরো শক্তিশালী হবে কিন্তু আমরা সম্ভবত আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি।
সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তি আমাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলাপ আলোচনার পাশাপাশি আমাদের বাস্তব জীবনেও সংগঠনচর্চা করতে হবে। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারতো, কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটিও অনেকাংশে অর্থকড়ির কাছে বন্দি হয়ে সাংস্কৃতিক বিকাশে তাদের দায়বদ্ধতার জায়গায় সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
অবশ্য ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠনের মাধ্যমে তরুণ সমাজ এটা প্রমাণ করেছে প্রয়জনে তারা রাজপথে নামতে জানে। গণজাগরণ মঞ্চের এই তরুণদের আমার কাছে জাহানারা ইমামের আদর্শিক উত্তরসূরী মনে হয়েছে। এখানে একটি ব্যাপার লক্ষণীয় এই তরুণদের বড় একটি অংশ নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া। এরা একদিক থেকে সৌভাগ্যবান যে বেড়ে ওঠার সময়টাতে তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে পেরেছে, জানতে পেরেছে যা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম পায়নি দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তির অবস্থানের কারণে।
সম্ভবত সেটি তাদের মনন গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। গণজাগরণের তারুণ্যের কাছে আমার বিপুল প্রত্যাশা ছিল, যা সর্বাংশে তারা পূরণ করতে পারেনি। অবশ্য একটি অসংঠিত প্রগতিশীল আন্দোলন হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে যে ধরনের সমর্থন কাম্য ছিল সেটি তারা পায়নি। এর আগে আমরা যেমন দেখেছি জাহানারা ইমামের গণ আদালতের সময় আওয়ামী লীগের একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, এক্ষেত্রে সেটি লক্ষ্য করা যায়নি।
আমি মনে করি বিদ্যমান প্রগতিশীল শক্তিগুলোর আরো বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে যাতে লক্ষ্য অর্জন সহজতর হয়। এতদসত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা ব্যর্থ এটি বলা যাবে না। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, আয়ুষ্কাল ইত্যাদি বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচকে আমরা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছি।
এখন আমাদের গুণগত পরিবর্তন দরকার। এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা যদি পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিশুদের চেতনা বিকাশের কার্যক্রম সঠিকভাবে পালন করতে পারি তাহলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্যাটি প্রধানতম হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। তবে আশার ব্যাপার হলো আমাদের জনগণের মানসকাঠামো এখনো ততোটা কলুষিত হয়নি যতোটা হয়েছে রাজনীতিবিদদের।
বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের যোগসূত্রও খবরের কাগজে উঠে এসেছে। রাজনীতিকে বলা হয় সমঝোতার আর্ট। কিন্তু সমঝোতা যদি মৌলিক আদর্শের সাথে হয় সেটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক। আমি মনে করি এই সাম্প্রদায়িক সংঘাতলিপ্সু অপগোষ্ঠীর সাথে ন্যূনতম কোনোরকম সমঝোতা কেবল রাষ্ট্র না যারা সরকারি দলে আছেন তাঁদের জন্যও বিপদজনক হবে।
এটি হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই আত্মহননের পথ থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে বঙ্গবন্ধুর জীবনাচরণ ও আদর্শ অনুসরণ করা। আমি এক্ষেত্রেও তরুণদের দিকেই তাকিয়ে থাকবো। রাজনীতিবিদরা পিছিয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু তরুণদের পিছিয়ে পড়লে চলবে না কারণ এই জাতির সমস্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে তারা উজ্জ্বলতম অংশীদার।
অনুলিখনঃ সঞ্জীবন সুদীপ
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)