চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘দক্ষ নারীকে প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারে না’

অবসরে গেলেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী বিসিএস কর্মকর্তা ফাতেমা বেগম। অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে গেছেন তিনি। ১৯৫৮ সালের ১৪ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার টুঙ্গিবাড়ী থানার হাসাইল গ্রামে তার জন্ম, ১৯৮৪ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে যোগ দেন ফাতেমা বেগম। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি চাকরিতে স্থায়ী হন।

সম্প্রতি কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন অ্যাওয়ার্ড-২০১৭’-তে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের কথা।

চ্যানেল আই অনলাইন: প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ৩১ বছরের কর্মজীবনের পর অবসর, কেমন লাগছে?
ফাতেমা বেগম: আমি অবসর নিয়েছে ১৩ এপ্রিল, পরের দিন ছিল পহেলা বৈশাখ। ফলে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। এখন সরকারী বাসায় থাকি, বাসাও ছাড়তে হবে, সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি ফলে অবসরে যে খারাপ লাগা সেটা এখনো টের পাচ্ছি না।

চ্যানেল আই অনলাইন: পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে গেলেন, পুলিশের কাছে এখন আপনার প্রত্যাশা কি?
ফাতেমা বেগম: পুলিশ এখন যে অবস্থায় আছে, দেশে বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে, আমি চাইব এটা অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে। এখন মানুষের যে অভিযোগগুলো রয়েছে তা সংগত কারণে রয়েছে আমি মনে করি এগুলো অনেকাংশে দূর হয়ে যাবে।

চ্যানেল আই অনলাইন: নারী পুলিশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন অ্যাওয়ার্ড-২০১৭’-তে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন, কেমন বোধ করছেন?
ফাতেমা বেগম: আমি আমি অ্যাওয়ার্ড, পদক মেডেল এগুলো নিয়ে কখনো ভাবি না। কারণ আমি মনে করি আমি এগুলোর যোগ্য না। আমি এ পদকের কথা জানতামও না। তবে আমার সহকর্মীরা এ পদক আমাকে ভালোবেসে দিয়েছে তাই আমি আনন্দিত ও গর্বিত।

চ্যানেল আই অনলাইন: প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে অধীনস্থদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল আপনার?
ফাতেমা বেগম: বড় পদে দায়িত্ব পালনের সময় তার অধীনে যারা থাকে তাদের সঙ্গে যদি আন্তরিক ব্যবহার করা যায় তাহলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।আমি যেখানেই কাজ করেছি সেখানেই সহকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। ফলে আমার সহযোগিতা পেতে কোনো সমস্যা হয় নি।অনেকে গালি গালাজ করে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু আমার আন্তরিকতা দিয়েই কাজ আদায় করে নিতাম।

চ্যানেল আই অনলাইন: কাজের সময় সূচী গোছাতেন কিভাবে?
ফাতেমা বেগম: লিও টলস্টয় একটি কথা বলেছিলেন, যখন যে কাজটি প্রথমে হাতে আসবে সেটাই প্রথমে করতে হবে। আমি সেটাতে বিশ্বাসী। যখন যে কাজটা এসেছে সেটাই প্রথমে করেছি।

চ্যানেল আই অনলাইন: কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ছিল কিনা?
ফাতেমা বেগম: কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ছিল না, তবে আমি যখন চাকুরীতে প্রবেশ করতে যাই তখন প্রবল এক আপত্তি ছিল যে পুরুষের এই উর্ধ্বতন পদে নারীরা কাজ করার যোগ্য না। সারদা’র ট্রেনিংয়েও সমস্যা হয়েছিল, তবে আমি পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়েই এই পদে এসেছি ফলে যারা আমাকে নিয়ে আপত্তি করেছিল বাদ দেবার চিন্তা করছিলো তারা পারে নি। এছাড়াও তাদেরকে আমি শক্তভাবেই বলেছিলাম যে আমি পারব।

চ্যানেল আই অনলাইন: কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে কি করণীয়?
ফাতেমা বেগম: প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রথমেই দরকার আত্মবিশ্বাস, তারপরেই দরকার কঠোর পরিশ্রম, যে পরিশ্রমের কারণে কেউ আর তাকে অবহেলা করতে পারবে না।তার যদি দক্ষতা থাকে প্রাথমিক ভাবে কিছু প্রতিবন্ধকতা আসে,তবে পরে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

চ্যানেল আই অনলাইন: নিজের কাজের দায়িত্ব উপভোগ কতোটুকো করেছেন?
ফাতেমা বেগম: দায়িত্বটা পুরোপুরি আমি উপভোগ করেছি।কারণ আপনারা যারা বাইরে থেকে মনে করেন পুলিশ একটা ফোর্স আসলে তা না পুলিশ হল সেবা।মানুষকে সার্ভিস দেওয়া পুলিশের কাজ। পুলিশের নারী কর্মকর্তা হিসেবে আমার আচরণ ছিল আন্তরিক, তাই মানুষের আস্থা ছিল অনেক। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আমার কাছে আসত। আমি তাদের জিজ্ঞাস করেছি আামার চাইতেও বড় কর্মকর্তা থাকতে এতো দূর থেকে আমার কাছে কেন এসেছেন; তারা বলত তাদের বড় কর্মকর্তাদের কাছে প্রবেশাধিকার ছিল না। আসলে আমার কাছে ছিল অবারিত দ্বার।সবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে পারত, আমাকে জনসাধারণ পছন্দ করত। বিশ্বাস করবেন না আমার অবসরের কথা শুনে অনেকে অফিসে এসে কেঁদেছেন। বলেছে, এখন আমাদের কি হবে? সব কিছু মিলিয়ে আমি পরিপূর্ণ ভাবে আমার কাজের দায়িত্ব উপভোগ করেছি।

চ্যানেল আই অনলাইন: আপনার কর্মজীবনের একটি সাফল্যজনক অপারেশনের ঘটনা শুনতে চাই
ফাতেমা বেগম: আমি সুপারভাইজার লেভেলে পুলিশে ঢুকেছি, আমি তদারকি করতাম। আমার তত্বাবধানে অনেক সাফল্য জনক অপারেশন পরিচালিত হয়েছে। অপারেশনের সময় ওই টিমকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতাম। তবে ঠাকুরগাঁওতে থাকার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান হিসেবে আমার সহকর্মীদের (সদর থানার পুলিশ)সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল। ওটা ছিল প্রবল একটা প্রতিবন্ধকতা।রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি বলেছিল আপনি সমাধান করতে না পারলে আমি আসব, আমি স্যারকে না করেছিলাম। বলেছিলাম আমিই পারব এবং মজার বিষয় ছিল ঝামেলা ছিল সরকারী দলের সঙ্গে, ওইসব ঝামেলা আমি সফলভাবেই শেষ করেছিলাম।

চ্যানেল আই অনলাইন: পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে অনেক নারী নিয়োগ পাচ্ছে, পরিবর্তনের এই ধারাকেআপনি কিভাবে দেখেন?
ফাতেমা বেগম: সার্বিকভাবে অবশ্যয় এটি একটা ভালো দিক যে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, আসলে একটা সময় আমরা কল্পনা করতে পারতাম না। একটা উচ্চ পদে আমি নিজেই ছিলাম। নারীর ক্ষমতায়নে যে ধারা এখন চলতে তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।তিনি নারীর ক্ষমতায়ন তুলে ধরেছেন। শুধুমাত্র নারী বলে নয়, আমাদের দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তাই দেশের উন্নয়নে এই অর্ধেক নারী গোষ্ঠীকে তিনি ক্ষমতায়নে কাজে লাগিয়েছেন।

চ্যানেল আই অনলাইন: আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই
ফাতেমা বেগম: আমার জন্ম গ্রামে, তবে আমি মুক্তমনা ছিলাম। ছোট বেলায় আমার যতোদূর মনে পড়ে, আমার পরিবার কোনো বাধা নিষেধ আরোপ করেনি। একটা পর্যায় পর্যন্ত ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে, পুকুরে সাঁতার কাটে।আমার পরিবার থেকে কোনো ধরণের বাধা নিষেধ আসে নি যে তুমি মেয়ে, তুমি গাছে উঠতে পারবে না, নৌকা চোলাতে পারবে না, সাঁতরাতে পারবে না।আমি প্রচুর গল্পের বই পড়তাম, সেখানেও আমার পরিবার বাধা দেয়নি।পড়ালেখা ঠিক রেখে বই পড়তাম। আমার কৃষক পরিবার, উঠানে সব সময় কোনো না কোনো ফসল থাকত। আমি পড়াশুনার ফাঁকে সাংসারিক কাজও করতাম।

চ্যানেল আই অনলাইন: চ্যানেল আই অনলাইনকে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

ফাতেমা বেগম: চ্যানেল অাই অনলাইনকেও আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

রিপোর্টটির ডিজিটাল শর্ট দেখুন: