বাসার টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা কখনও কাজ না করলে মুহূর্তে মেজাজ যায় বিগড়ে। বিকল হবে কেন? দু-চারটা টাক দিয়ে ব্যটারি খুলে, আবার লাগিয়ে….সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সচল করবার।অবাক ব্যাপার হলো, ভুলেই যাই যে রিমোট কন্ট্রোলের ভেতরে থাকা ব্যটারিগুলোর পথচলার সময় শেষ। বদলাতে হবে ওগুলোকে। হাতে থাকা রিমোট কন্ট্রোলের গল্পটা ছড়িয়ে দেয়া যাবে দেয়ালেও।
ঘড়ির কথা বলছি। আমরা ধরেই নেই, দেয়াল ঘড়িটা চলবে অবিরাম। এমনকি ব্যাটারি শেষ হলেও থেমে থাকা ঘড়ির সময় দেখেই পার করেছি দিনের পর দিন। চলার গল্প, এগিয়ে যাওয়ার গল্প এগুলো কার না ভালো লাগে। কিন্ত, থেমে যাওয়াকে মেনে নিতে বড় কষ্ট আমাদের। শৈশবের অবুঝ আদুরে ভাবটা থামিয়ে দিতে হয় কৈশোরে। তারুণ্যে থেমে যায় কৈশোরের সরলতা। যৌবনে থামে তারুণ্যের টগবগে উদ্যম। আর বাধর্ক্যে শুধুই একেবারে থেমে যাওয়ার অনিচ্ছার অপেক্ষা।
আমরা হয়তো ওই “একেবারে থেমে যাওয়া” অর্থাৎ মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন চিন্তায় থামতে ভয় পাই। অস্বস্তিতে ভুগি “অচল” কিছু নিয়ে। বিষয়টার সাথে Abject খুব মিলে যায়। সেটা আবার কী? একটু গুগল করে দেখে নিতে পারেন। এই থামতে অরুচি আমাদের আবার থামানোতে বড় আগ্রহ। শিশুরা একটু বেশি বুঝলে বলি, “এত পাকামি করতে হবে না”। আবার বড়দের শিশুসুলভ আচরণকে বলি”ন্যাকামি”। কেউ খারাপ কিছু করলে তো দায়িত্ব নিয়ে থামাতেই যাই।মজার ব্যাপার হলো, ভালো কিছু থামাতেও জুড়ি নেই আমাদের! অন্যের বড় বক্তৃতা শুনে হয়তো চোখের কোণে ঘুম জমে, সেই আমরাই আবার মাইক্রোফোনটা হাতে পেলে অপেক্ষা করি ওটার “ব্যাটারি” শেষ হওয়ার।
এবার প্রকৃতিতে ফিরি। শীত আসলে তাকে থামাতে চাই আমরা, “এবার যে তীব্র শীত”! আবার গরমকেও চাই দূরে ভাগাতে “এর চেয়ে শীতকাল ভালো”। আর বর্ষাকে কবিমন নিয়ে ঠিক ততক্ষণই ঝড়তে বলি, যতক্ষণ ওই বৃষ্টিস্নাত কাদা প্যাচপ্যাচে দিনে হাতে বাজারের ব্যাগটা না ওঠে। প্রকৃতিও ভালো পারে। আমাদের এসব থামাথামির খেলায় ছয় ঋতুর তিনটিকে দিয়েছে থামিয়ে। শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত এখন শুধু মুখের কথায় আর কলমের আঁচড়েই আসে আর যায়। এতো থামার গল্প, তারপরেও শিরোনামে কেন বলছি “থামতে জানতে হয়”?
আসলে ব্যাপারটা হবে, “সময়মতো” থামতে জানতে হয়। সময়টা কখন? আমার বাবার মুখে একটা কথা শুনেছি” যশ থাকতে কীর্তন শেষ করতে হয়” এটাই বোধহয় থামতে জানার বিদ্যা। ব্রায়ান লারাকে ভুলতে পারবেন? ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে ৫০০ আর টেস্টে ৪০০ করা একমাত্র মানব। অথচ, ক্যারিয়ারের টগবগে সময়েই হঠাৎ করে থামিয়ে দিয়েছেন নিজেকে! তাই তার থেমে যাওয়ার আক্ষেপটা এখনও পোড়ায় আমাদের। অন্যদিকে সৌরভ গাঙ্গুলির “শেষ দেখে ছাড়বো” মনোভাব কারও কারও বিরক্তির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছিল!
থামতে জানার জ্ঞানটা আমার নিজের মধ্যেই তো কম। এই যে…লিখেই যাচ্ছি, লিখেই যাচ্ছি। এবার থামবো। জীবনটা থেমে যাওয়ার আগে, নিজেকে উদ্ভাসিত করতেই…থামুন। একবার না। বারবার থামুন। তবে থামুন “সময়মতো”। প্রতিরাতের ঘুম তো একপ্রকার থেমে যাওয়া, যার ওপারে একটা উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন আছে। আপনার থামার ওপারেও থাক সেই আলোর স্বপ্ন। যে থামতে বলবে, সেই সিগন্যালের লাল আলো যদি কখনও বিকল হয়ে যায়? তা আবার হয় নাকি? হয়। কখনও সখনও হয়।
“থামতে। থামাতে উঠতে নামাতে। একদিন থেমে যাব আমার এই আমাতে”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)