সেবা প্রদানের উদ্দেশে গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্যাকেজের’ মাধ্যমে সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রাম-ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ও কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা প্রদানে সরকার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়োগ দিয়েছে। আর জনগণ পাচ্ছে তাদের হাতের নাগালে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা।
তৃণমূল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে নিভৃত গ্রামাঞ্চলে গড়ে তোলা কমিউনিটি ক্লিনিক জনগণের স্বাস্থ্য সেবার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রসূতি মায়ের নিরাপদ প্রসবসেবা সহ বিভিন্ন গুরুতত্বপূর্ণ সেবা ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রাম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য সহকারীরা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করছেন। তারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধিরা এই স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন।
বর্তমানে দেশে ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পরিকল্পনাসেবা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরামর্শসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়।পল্লী অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করাই এখন প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ এখনও গ্রামে বাস করেন। স্বাধীনতার সুফল হিসেবে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের সাথে গ্রামের সমাজ জীবনের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যেখানে দরিদ্র ছিল ৮২ শতাংশ, আজ তা ২২.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সহ সর্বক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন মাপকাঠিতে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের চেয়ে অগ্রগামী। এসব উন্নয়নের পরেও গ্রামাঞ্চলে কম হলেও শোষণ, বঞ্চনা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে- এগুলো যেমন সত্য। তেমনি আরও বেশি সত্য যে গ্রামীণ জনপদে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সমঝোতা আছে। বিভিন্ন ধনী-দরিদ্র্য, দক্ষ-অদক্ষ নানা শ্রেণি ও পেশার এবং বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অবস্থান হলেও গ্রামাঞ্চলে তাদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত একটি ঐক্যের দৃশ্যমান উপস্থিতি আছে। এই ঐক্য এক সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য, বসবাসযোগ্য ও উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখে।
শিক্ষা, কর্ম বা অন্য যেকোন কারণে গ্রাম ছেড়ে যারা শহরে বা দূরদেশে অবস্থান করেন, এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত ঐক্যের জন্যই তারা যেকোন সার্বজনীন সকলের সাথে ভাগাভাগি করে উদযাপনের জন্য শত কষ্ট উপেক্ষা করে গ্রামে ফিরে যান। গ্রামের আত্মীয়, নিকটাত্মীয় বা অনাত্মীয় লোকজনের সাথে আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করা বা তাদের উন্নয়নে কাজ করা বা তৃপ্তি লাভ করার জন্য যে দায় কাজ করে, তাকে বলা হয় সামাজিক দায়িত্ব। এই সামাজিক দায়বদ্ধততার কারণেই আমরা হৃদয়ের মধ্যে স্বদেশের একটি সুন্দর চিত্র লালন করি। আর তা হলো আমাদের নিজ নিজ গ্রাম। ব্যক্তি জীবনের এই সামাজিকতার দায়িত্ববোধ এবং পল্লী অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহ্যগত বুনন যত শক্তিশালী হবে, সমাজ শরীর তত সুস্থ থাকবে, প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাবে ও তা আরো বেশি টেকসই হবে।
দারিদ্র্য শুধুমাত্র দরিদ্র মানুষের সাথে বাস করে। কিন্তু রোগ ধনী-দরিদ্র বিচার করে না। বরং কিছু সংক্রামক রোগ নির্মূল হওয়ায় বা এসব রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বচ্ছল মানুষের মধ্যে অনেক রোগের প্রবণতা এখন বেশি। সেক্ষেত্রে এরূপ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের জনগণকে সংগঠিত করে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করা গেলে তা কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনায় স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করবে। এবং একইসঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা প্রদান ও সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেটুকু ব্যবধান এখনও আছে তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
এ ব্যবস্থাপনা যেমন ব্যক্তি ও পরিবারে চিকিৎসাসেবা গ্রহণে তথা সুস্থ জীবন-যাপনে অবদান রাখবে, একইসঙ্গে পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে প্রবাহিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করবে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি গ্রুপের সহায়তার মাধ্যমে প্রত্যেক সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রতি বছর স্বাস্থ্য মেলার আয়োজন করার সুযোগ তৈরি হবে। এ সামাজিক ঐক্য বৃদ্ধির এরূপ স্বাস্থ্য মেলার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত তৃণমূল পর্যায়ের সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখবে।
কারণ সচেতনতা বৃদ্ধিতে মেলা আবহমান গ্রাম-বাংলার একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। সে প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনায় জনগণের সম্পৃক্তকরণ ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করার কাজ বর্তমানে চলমান প্রক্রিয়া। অপরদিকে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহ্যগত ঐক্য বৃদ্ধি ও দারিদ্র্র্য বিমোচন প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই সমাজের সকলকে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করে ব্যক্তি ও সামাজিক সুস্থতায় বিশেষ অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি অত্যন্ত যৌক্তিক। এ কার্যক্রমে সমাজের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। তাহলে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)