মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা বিশ্বে বিরল ঘটনা বৈকি। তার উপর প্রতিপক্ষ যদি হয় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পাকিস্তানের মতো দেশ, যাদের মদদদাতা ও পিছনের শক্তি ছিল সুপার পাওয়ার আমেরিকা ও চীন। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধের মাত্রা কতটা নিখাঁদ হলে একটা দেশের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে!
যে যেখান থেকে পারছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কর্মজীবী-বেকার, নারী-পুরুষ ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ আত্মপরিচয় ও মর্যাদার প্রশ্নে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ নয় মাস এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ যুদ্ধে আমরা ত্রিশ লাখ স্বজাতিকে হারিয়েছি। কয়েক লক্ষ মা-বোন তাদের ইজ্জত ও সম্ভ্রমহানী হয়েছেন।
যেসব মুক্তিকামী যোদ্ধা বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন সেইসব মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমাদের নমস্য। কেবল বিশেষ সময় নয় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবনে মরণে আমাদের কাছে পূজনীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
আজকের এই লেখায় আমি এমন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব, যারা একেবারে অজপাড়া-গাঁ’র মানুষ হয়েও জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। সম্ভ্রান্ত কোনো পরিবারের সদস্য কিংবা আহামরি শিক্ষিত না হয়েও শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রবল টানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। বিজয়ের মাসে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এই আয়োজন আমাদের পড়শি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।
১. বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর ১৯৫৪ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পলাশকান্দা গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মরহুম নেওয়াজ আলী মন্ডলের ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মনসুর সবার বড়। মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে ১৯৭০ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টে সাধারণ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর। তৎকালীন মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরের অধীনে দেশের প্রয়োজনে বীরদর্পে যুদ্ধ করেছেন তিনি। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এম এ মনসুর সহযোদ্ধাদের সাথে আগরতলার মনতলা ক্যাম্প হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে নোয়াখালির বেলুনিয়া পর্যন্ত জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ও ল্যান্সনায়েক সিদ্দিকুর রহমানসহ সহযোদ্ধাদের অনেককেই শহীদ হতে দেখেছেন যুদ্ধের ময়দানে। পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনিও প্রায় মরতে বসেছিলেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন সত্য তবে পিছু হটেননি যুদ্ধের মাঠ থেকে। হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে লড়ে গেছেন পুরো নয় মাস ব্যাপী। ওদেরকে পরাজিত করে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরেছেন ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর।
স্বাধীনতার পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পুনরায় যোগদান করেন। পূর্ণকালীন চাকরি শেষে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সহকারি কমান্ডার এম এ মনসুর উপজেলা জাতীয় পার্টির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচিত সভাপতিও তিনি।
চাকরির পেনশন সুবিধা ছাড়াও মাসিক ১০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন ক্যাপ্টেন মনসুর। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাপ্টেন মনসুরের কিছুটা হতাশা থাকলেও তিনি আশাবাদী। বর্তমানে তিনি ভালো ও সুস্থ আছেন।
২. বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার ফকির
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করে তাক লাগিয়ে দেন আব্দুল জব্বার ফকির। ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে সবার ছোট আব্দুল জব্বার ফকির। পিতা ইলাহি বক্স ফকির একজন সাধারণ কৃষক হলেও ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। তিনি নিজে কৃষিতে মাথা ঘামালেও ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। পড়ালেখা শিখে শিক্ষিত হোক, আল্লাহর কাছে ইলাহি বক্সের চাওয়াটা এমনই ছিল। যদিও তার ইচ্ছের ডানা বেশিদূর মেলেনি।
ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলাধীন তারুন্দিয়া ইউনিয়নের বাখুরীপাড়া গ্রামে ১৯৫৭ সনের ১৬ মে নিজ বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার ফকির। ১৯৭১ সন। দেশব্যাপী তুমুল যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আব্দুল জব্বার সবেমাত্র ৯ম শ্রেণির ছাত্র। এইটুকু বয়সেই যুদ্ধে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে বসেছে সে। কিন্তু, মনের কথাটি সে কাউকেই বলে না, বলতে পারেন। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। একদিন বড় ভাই নবী হোসেন ফকিরের কাছে তার অদম্য ইচ্ছার কথা জানালেন।
শুরুতে নিষেধ করলেও পরে বড় ভাই নবী হোসেনই তাকে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন। প্রেরণা জুগিয়েছেন। ভাইয়ের চেষ্টায় একসময় আব্দুল জব্বার ভারত পাড়ি দেন। মাঝখানে গৌরীপুরের হাতেম আলী (পরে এমপি) ও ময়মনসিংহের প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান (বর্তমান ধর্মমন্ত্রী) এই দু’জনের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় তিনি ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শিবিরে রিক্রুট হোন। ২১ দিনের ট্রেনিং আর ‘৭ দিনের কসম প্যারেড’ শেষে আব্দুল জব্বার অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় আসেন।
এখানে বেশ কিছু রাজাকারদের সাথে ছোটখাট যুদ্ধে অংশ নেন। দেশমাতৃকার মুক্তির প্রয়োজনে এটাই ছিল আব্দুল জব্বারের ১ম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকার গুরুতর আহত হয়। তারপর ময়মনসিংহের কড়ইতলা, সর্চাপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে দলবল নিয়ে অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্থানী সৈনিকদের সাথে যুদ্ধ করার কোনো সুযোগ পাননি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে মাত্র একমাস যুদ্ধ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর তারা ময়মনসিংহ কৃষিবিদ্যালয় এলাকায় কিছুদিন অবস্থান করেন। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর যুদ্ধাস্ত্র জমা দিয়ে বীর বেশে এই শিশু মুক্তিযোদ্ধা বাড়ির দিকে ফিরেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার ফকির অটো প্রমোশন নিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এবং পরবর্তিতে মেট্রিক পাশ করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি প্রকল্পে তিনি দীর্ঘদিন চাকরি করার পর ১৯৯৮ সনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চতুর্থ শ্রেণির একটি চাকরিতে স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে তিনি সেখানেই কর্মরত আছেন। তার বড় মেয়ে হ্যাপী আক্তার পিতার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুযোগ পেয়েছেন।
আব্দুল জব্বার সংসার জীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। মেঝো ছেলে কিছু না করতে পারলেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট মেয়েটি খুবই মেধাবী ও ভালো ছাত্রী। আব্দুল জব্বার ফকির চাকরির নিয়মিত বেতনের সাথে মাসিক ১০ হাজার টাকা হারে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। তিনি ভালো আছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেশ ভালো আছেন আব্দুল জব্বার।
৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার
মোঃ আব্দুস সাত্তার। বীর মুক্তিযোদ্ধা। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের বাখুরিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার। ১৯৫৩ সনের মে মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রয়াত নেওয়াজ আলী। চার ভাই ১ বোনের মধ্যে আব্দুস সাত্তার জ্যেষ্ঠ। গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আব্দুস সাত্তার ছোট বেলায় পিতৃহারা হন। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স সবেমাত্র ১৭ বছর। একদিন বাড়িতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আসেন।
তাদের একজনের সাথে কথা বলে আব্দুস সাত্তার যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা পান। পিতাহীন সংসারে বড় সন্তান হিসেবে ভালো করেই জানতেন, যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে কখনো অনুমতি পাবেন না তিনি। তাই কাউকে না জানিয়ে একদিন বাড়ি থেকে পলায়ন করলেন। অনতিদূর বয়রা বাজারে গিয়ে এডভোকেট নাজিমুদ্দিনের সহযোগিতায় তিনি ভারতে পাড়ি জমান।
সেখানে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ২১ দিনের ট্র্বেনিং নিয়ে অক্টোবরের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কংস নদীর পাড়ে নয়ার হাট এলাকায় প্রথমেই একটা বড় ধরণের যুদ্ধে অংশ নেন। এ যুদ্ধে সহযোদ্ধা ৪ জন শহীদ হয়েছেন। এ যুদ্ধে আব্দুস সাত্তার ভাগ্যক্রমে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। যুদ্ধে জয়ী হয়ে এখান থেকে হালুয়াঘাট, নাগ্রা ফুলপুর ও সর্চাপুর এলাকায় চলে আসেন। এখানে ছোটখাট কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ ময়মনসিংহ মুক্ত হলে তারা ময়মনসিংহ শহরে জেলাস্কুলে সমবেত হন। তারপর অস্ত্র জমা দিয়ে আরো কিছুদিন পর বাড়িতে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সনে তিনি রক্ষী বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আব্দুস সাত্তার রক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযুক্তি লাভ করেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১৫ বছর চাকরি শেষে বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।
সরকারী চাকরির পেনশন ছাড়াও তিনি মাসিক ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার এক ছেলে ও এক মেয়ের পিতা। ছেলে মেয়েরা বেশিদূর লেখা পড়া করতে পারেনি। তবে, ছেলে ও মেয়ের দিক থেকে দুই নাতনীকে তিনি নিজ দায়িত্বে পড়ালেখা করাচ্ছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)