পেশাগত কারণেই শুধু নয়, ভাললাগাও ছিল। কথা ছিল অনেকের মতো আমারও ব্যথিত হয়ে শোক করার। কিন্তু হয়নি। এখানেই বাধা দিয়েছে পেশা। অন্য আর দশজনের মত আমাকেও স্বাভাবিক থাকতে হয়েছে।পরপর তিনটি মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে। কিন্তু তা নিয়ে ভাবনার সুযোগ হয়নি। এক দণ্ড শোকের সুযোগ আসেনি। তিনটি মৃত্যুই কাছে থেকে দেখেছি। রিপোর্ট করেছি। নিজেকে মনে হয়েছে বুঝি মানুষ নই, রিপোর্টার, যন্ত্র।
সকালে দক্ষিণ এশীয় সাংবাদিক সম্মেলনের এ্যাসাইনমেন্ট ছিল। হোটেল শেরাটনে। কেমন যেন ঝিম ঝিম, অস্থির লাগছে। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যায় প্রতিবেদন লিখে বসে আছি। একটু দেরি করে গিয়েছিলাম এসাইনমেন্টে। এজন্য ইউএনবি’র নিউজ থেকে নামগুলো মিলিয়ে নিয়ে জমা দেয়ার অপেক্ষা। লম্বা সাদা কাগজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট হয়ে আসবে এই নিউজ। আর তা আমার হাতে আসলে মেলাবো। হঠাৎ সাইফুল ভাইয়ের অস্বাভাবিক গলা শুনলাম। সাইফুল আমীন, তখন আমার চীফ রিপোর্টার। সংবাদ এর ঘটনা এটা। ৩৬ পুরানো পল্টন। কেউ একজন টেলিফোন করেছেন তাঁর কাছে। নিজের চেয়ার থেকে ততক্ষণে পড়িমরি করে ছুটে এসেছেন। এক হাত দিয়ে এক কানে মোবাইল ধরা। অন্য হাত দিয়ে অন্য কান বন্ধ রাখা। অপর পাশের কথা যেন ভাল ভাবে শুনছেন না। কিন্তু ভয়ংকর কিছু শুনছেন এটা বোঝা যাচ্ছে। এক জায়গাতে স্থিরভাবে কথা বলছেন না। উনি উত্তর দিচ্ছেন, ‘কি? শেখ হাসিনা কোথায় আছে কেউ জানেনা? তাকে পাওয়া যাচ্ছে না? পনের জন মারা গেছে? বোমা না গুলি? এখনো গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে? গুলি হচ্ছে? আপনারা কোথায় এখন? সবুজ কোথায় এখন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কম্পিউটার থেকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সাইফুল ভাইয়ের সামনে। অফিসে যারা ছিলাম, প্রায় সবাই উঠে দাঁড়িয়েছি। ওপাশ থেকে সালাম ভাই (সালাম জুবায়ের) এর ফোন।আওয়ামী লীগ সমাবেশে বোমা। অনেকে মারা গেছেন। ৩/৪ জন রিপোর্টারকে সাথে সাথে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দিলেন। আমি যেতে চাইলাম, দিলেন না। অফিসে কারো থাকা দরকার। তাড়াহুড়ো করে প্রিন্ট দিয়ে দিলাম হাতে জমে থাকা প্রতিবেদনটা। যদিও প্রতিবেদন তখনও শেষ হয়নি। সে অবস্থায়ই জমা দিলাম।
অফিসের কাউকে না জানিয়ে নিচে নামলাম। সংবাদ এর নিচের রাস্তাতেই একটা ভারি বাতাস পাওয়া গেল। রাস্তায় নেমেই বুঝলাম, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পল্টনের এই গলির মধ্যেও উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে মানুষ। মুহুর্তে দোকানপাট সব বন্ধ। সবার মুখে মুখে এক কথা, ‘শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলেছে।’প্রথমে দু’পা পিছিয়ে গেলাম। আবার রওনা দিলাম। আজাদ প্রডাক্টের সামনে দিয়ে, বায়তুল মোকারম আর জিপিও এর মধ্যে রাস্তা দিয়ে হাটা শুরু করলাম। সব কিছু অন্ধকার। এই সন্ধ্যে বেলায় মুহুর্তে মৃত্যুপুরি হয়ে উঠেছে। রাস্তার কোনার পিঠা, গরুর দুধের চা কিম্বা সোনার দোকান। কিছুই খোলা নেই। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে একটা দোতলা বাস পুড়ছে। দাউ দাউ করে। একটু পশ্চিমে জিপিও’র সামনে পুড়ছে আরও একটি দোতলা বাস। নূর হোসেন চত্বরে আবছা আলো। দলে দলে মানুষ ছুটছে মেডিকেলের দিকে। ভ্যান অথবা এ্যাম্বুলেন্স, করে। পায়ে জুতো নেই। মুখে শব্দ নেই। চোখে আতংক। কারো সাথে কথা বলার সুযোগ নেই। তবু চেষ্টা করলাম। কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। শুধু হাপিত্যেস। শোক আর শ্লোগানে অন্য এক ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। অন্ধকার মৃত্যুপুরী। বিদ্যুৎ নেই। মুখর মানুষগুলো মুক হয়েগেছে। অপেক্ষা করতে করতে একটু পাশেই, চোখের সামনে আরও একটা বোমা ফুটলো। এতে আহত হলেন একজন বৃদ্ধ। কে কাকে ধরে? কে কাকে বাচাঁয়? সবাই তো আহত। কেউ শরীরে। কেউ মনে।
২৩ নম্বরের ঠিক সামনে না যাওয়া পর্যন্ত কি যেন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছিল। এক পা দু পা অপেক্ষা করতে করতে সানমুন টেইলার্সের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখানে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামতেই কিছু একটার সাথে পায়ে ছোট্ট হোঁচট পেলাম। জীবন্ত কি মৃত বোঝার আগেই নিজেই লাফিয়ে উঠলাম। আলো আধারের মধ্যে দেখলাম ছোট আনারসের মত একটা গ্রেনেড। অসংখ্য জুতার ছড়া ছড়ি। অনেকটা -জুতার স্তুপ। কালো একটা জুতার উপরে এক ফোটা রক্ত। ২৩ নম্বর ভবনে ঢোকার আগে ফুটপাতের পাশে রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্ত। অফিসে এসে একটা ফিচার লিখলাম। পরের দিন ছাপা হলো ভালভাবে। তবে রাতে বুলবুল ভাই (মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, তখন সংবাদ এর নির্বাহী সম্পাদক,‘সংবাদ’) এর কাছে বকুনি শুনলাম। তার কাছে পাওয়া প্রথম বকুনি। সকালের এ্যাসাইনমেন্ট এর লেখাটা যথাযথ হয়নি। আমিও বুঝেছিলাম। বকুনিটা প্রয়োজন ছিল। মনে পড়লো, অসম্পূর্ণ প্রতিবেদনের কথা। অনেকের নাম লেখা হয়নি।রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন পল্টন থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত রাস্তায় কাঁচ বিছানো। কাঁচ আর কাঁচ। মানুষ আছে একজন, দু’জন। সোডিয়াম আলোয় আমার গায়ের নীল শার্টটা কালো লাগছিল।পরের দিন দৈনিক যুগান্তরে, আমার এ্যাসাইনমেন্টের সেই অনুষ্ঠানে যারা যায়নি তাদের নামও ছাপা হয়েছিল। আর সেজন্য আগের দিনের বকুনিটা আমার কিছুটা কম পাওনা বলে জানালেন বুলবুল ভাই। দৃশ্যপট দুই
সন্তোষ গুপ্ত। প্রথিতযজা, সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি তখন অসুস্থ। অফিস থেকে সাইফুল ভাই আমাকে দায়িত্ব দিলেন তাঁর খোঁজ রাখার। কোমায় রাখা হয়েছে। যন্ত্রের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। যন্ত্র খুললেই সব শেষ। কখন যন্ত্র খোলা হবে যেন সেই অপেক্ষা। সেদিন শুক্রবার। ৬ই আগষ্ট। সকালেই বারডেম গেলাম। আমার গায়ে নীল শার্ট। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম, সন্তোষ দা আর নেই। সে দিন আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো না। দাদার বাসায় গিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলে এসে প্রতিবেদন বানালাম। এরমধ্যে অন্যান্য কিছু পত্রিকায় তথ্য দিতে দিতে নিজেরই লিখতে একটু দেরী হলো। পরদিন বারডেম থেকে প্রথমে ‘সংবাদ’ অফিসে। সেখান থেকে প্রেসক্লাব। পর্যায়ক্রমে শহীদ মিনার, দাদার বাসা, বাসা থেকে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট। ‘সংবাদ’ থেকে মরদেহের সাথে ট্রাকে উঠেছিলাম। সাথে ছিলাম চিতার শেষ আগুন জ্বলা পর্যন্ত। মুখে আগুন দেয়া থেকে শুরু করে না-পোড়া নাভি বুড়িগঙ্গায় ফেলা পর্যন্ত। দাহ হয়েছে চার ঘন্টা ধরে । তিল তিল করে সে দৃশ্য দেখেছি। মাথার চুল। গায়ের লোম। চামড়া। শিরা-উপশিরা। মাথার খুলি। সে-ই সন্তোষ গুপ্ত’র মাথা, যা থেকে লেখা হয়েছিল ‘অনালোকে আলোকস্তম্ভ’ পরাভব না মানা সাংবাদিক, এখন পুড়ে কয়লা। ডোমরা দ্রুত করার জন্য ঘি ঢালছে। লম্বা বাঁশ দিয়ে মাংসপিণ্ডকে নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। চিতা থেকে ধোয়া উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট থেকে ফিরে আসি অফিসে। পরে বাসায়। কিন্তু কোথাও আর মন বসে না। কেবলই চোখে ভাসতে থাকে এক এক করে পুড়ে যাওয়া সন্তোষ দা’র অঙ্গ গুলোর কথা। তবে বেশিক্ষণ চোখ মেলে রাখা যায় না। প্রস্তুতি নিতে হয় পরের দিন নতুন কোন খবর লেখার জন্য।
দৃশ্যপট তিন
সেদিনও শুক্রবার। ১১ই আগষ্ট। সন্তোষ দা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। সকালে আর বের হবো না মনস্থির করে টেবিলে বসেছি। সন্তোষ দা’র শেষ সাক্ষাতকারটা লিখবো। সকাল দশটায় সাইফুল ভাই’র ফোন এল। কিছুদিন আগে জার্মানী থেকে ফিরেছি। সে কারণেই এ ফোন। ‘তোমার কাছে দাউদ ভাই এর (কবি দাউদ হায়দার, বার্লিনে থাকেন) ফোন নম্বর আছে?’ উত্তর দিলাম, আছে। ‘দ্রুত নম্বর নিয়ে অফিসে চলে এসো।’ সামনে নীল রং এর সেই শার্টটা। সেটাই গায়ে চাপিয়ে, কোন এক অজানা বিপদের গন্ধ নিয়ে দ্রুত অফিসে রওনা দিলাম। চোখে ভাসতে থাকলো দাউদ ভাই এর সাথে জার্মানি আর ফ্রান্সে ঘোরার বিভিন্ন স্মৃতি। মনে পরলো প্যারিসে শিল্পী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায় ইলিশের আশটে দিয়ে দাউদ ভাইয়ের স্যুপ রান্নার কথা।অফিসে তখনো মাত্র দু’একজন। সাইফুল ভাই এর টেবিলের সামনে এসে বসলাম। তখনো বুঝিনি। পরে জানলাম। কবি, লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ আর নেই। তিনি মারা গেছেন অথবা কেউ তাকে মেরে ফেলেছে। শুরু করলাম খোঁজ নেয়া ।
দাউদ ভাইকে পেলাম না। প্রদ্যোত এর (সন্তোষ দা’র মেয়ে অদিতি গুপ্তর বর। জার্মানি’র বার্লিনে থাকে) কাছ থেকে মিউনিখের আনিসুল হকের ফোন নম্বর নিলাম। আনিসুল হক বাসায় ছিলেন না। ফোন ধরলেন রোমানা হাশেম। মিউনিখের বাঙ্গালীরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। পরে ফোন করবো জানিয়ে খোঁজ নিতে বললাম। মিউনিখ থেকে সরাসরি, জার্মান দূতাবাসের মোর্শেদ ভাই (মুজতবা আহম্মেদ মোর্শেদ) আর হুমায়ুন আজাদের পরিবার থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন লিখলাম। রাতে ১২ টায় দাউদ ভাইকে ফোনে পেলাম। বিকালেই বলে রাখা ছিল। তিনি প্রতিবেদন তৈরী করে রেখেছেন, ফ্যাক্স করতে পারছেন না। ফোন করে শুনে নিয়ে লিখে দিলাম।
বার্লিন থেকে দাউদ ভাই, মিউনিখ থেকে আনিসুল হক আর এদিকে আমি লিখলাম। পরিবারের অভিযোগ, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে অন্যরা জানালো। ‘পিইএন’ ফেলোশিপে কয়েক দিন আগে তিনি গিয়েছিলেন জার্মানিতে। সেখানেই তার মৃত্যু।মনে পড়ছিল সেদিনের কথা। অফিস থেকে মুনীর ভাই (মুনীরুজ্জামান, তখন বার্তা সম্পাদক ‘সংবাদ’) কে অনেক বলে তাড়াতাড়ি বের হয়েছি। বাংলা একাডেমির বই মেলায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব। কিছুক্ষণ ঘুরে টিএসসিতে এসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ কয়েকটি বোমার শব্দ শুনলাম। বাংলা একাডেমির দিক থেকে ছুটে আসছে লোকজন। বন্ধুরাও ফিরে যেতে উদ্যত। বললাম, তোরা একটু দাঁড়া, আমি আসছি। পরিস্থিতি দেখতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকেই বোঝার চেষ্টা করলাম। হলো না। আর একটু এগিয়ে গেলাম। ফতুয়া পরা একটি মানুষ দাঁড়িয়ে। প্রথম পলক দেখেই মাথার মধ্যে ঝলক দিয়ে উঠলো। দু’একজন আছে তাকে ঘিরে। ফিরে আসবো বলে ভাবছি, কিন্তু হলো না। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। আবছা আলোর মধ্যে কোঁকড়া চুল দেখে আর চিনে নিতে দেরী হলো না। এক হাত দিয়ে থুতনি ধরা। একেবারে কাছে গেলাম। আরও দু’একজন তাকে ধরেছে। আইল্যান্ডের উল্টো দিকে একটা রিক্সা। চেষ্টা হচ্ছে রিক্সায় তোলার। কিন্তু কেউ পারছে না। আমিও যোগ দিলাম। উঠবেনই না। নাছোড়বান্দা। হেঁটেই যাবেন। বারবার বলতে থাকলাম, ‘স্যার রিক্সায় ওঠেন, স্যার রিক্সায় ওঠেন।’ বললেন, ‘আমি বাসায় যাবো। এ পথে। আমার চশমাটা কোথায়? দেখতো আমার চশমাটা কোথায়?’ বললাম, ‘স্যার চশমা আছে। আপনি আগে রিক্সায় ওঠেন।’ প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি আর উত্তেজনায় এসব কথা হচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে নির্বিকার। কিছুই হয়নি যেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর পারছেন না। পেছন থেকে একটা ছেলে তাকে ধরেছে। মানুষের জটলা বেড়েছে। কয়েকজন পুলিশকে দেখলাম। তারা দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার। কেন জানি হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। পুলিশের উপর রাগারাগি করলাম। টিএসসির মোড়ে বড় পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে। এদিকেই আসছিল, নাকি দাড়িয়ে ছিল তা খেয়ালের সুযোগ হয়নি। দৌড়ে গিয়ে ভ্যান ডাকলাম। রাস্তা তখন ফাঁকা। উপস্থিত আরও অনেকে মিলে কোন রকমে তাকে পুলিশের ভ্যানে তুলে দেয়া হলো। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। ‘মুনীর ভাই, কারা যেন হুমায়ুন আজাদকে বোমা মেরেছে। ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করে বললাম, ‘সম্ভবত কেউ কুপিয়েছে তাকে।’ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা হাজির হলেন পনের-বিশ মিনিটের মধ্যে। ফুটপাতের উপরে একটা চাপাতি পাওয়া গেল। পাওয়া গেল একটা ছোট্ট হাড়। পড়ে আছে একটা দাঁত। বেশ কিছু চুল। চুলগুলো পুলিশ ফেলে দিতে যাচ্ছিল। উপস্থিত একজন লুফে নিয়ে নিলেন। বললেন, ‘আপনার কাছে এর কোন মূল্য নেই। স্যারের চুলগুলো আমার কাছেই থাক।’ পড়ে থাকা হাড়ের অংশ কাগজে মুড়ে পকেটে রাখলেন সাধারণ সাদা পোশাক পরা পুলিশ।
রিক্সা নিয়ে মেডিকেল গেলাম। ততক্ষণে হাসপাতাল ভর্তি মানুষ। অপারেশন থিয়েটারের সামনে বাকী বিল্লাহ ভাই দাঁড়িয়ে। সমস্ত মাথা মুখ ব্যান্ডেজ করা। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সিএমএইচ-এ। দেখলাম স্পস্ট তাকিয়ে আছেন। যেন জিজ্ঞাসা, কি হয়েছে?আবার অফিস এসে প্রতিবেদন লিখলাম। লিখলেন হারুন ভাই, (হারুনুর রশিদ) বাকী ভাই (বাকী বিল্লাহ)। অফিসের কে যেন বলল, বাসার ভাই, আপনার শার্টে রক্ত কেন?সত্যিইতো! নীল শার্টটার হাতায়, বুকের কাছে রক্ত লেগে আছে।বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দু’টো। সবে শুয়েছি। এনটিভি থেকে ফোন। এনটিভির শিহাব সুমনের সাথে দেখা হয়েছিল ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই। লাইভ নিউজ করার জন্য আমার সাক্ষাতকার নিতে চায়। আমি সে সাক্ষাতকার দিতে চাইলেও বাবু ভাইয়ার (আমিরুল বাসার, আমার ভাই) কারণে তা আর হয়নি।
সে বছরের সেই আগষ্ট মাসটা এভাবেই কেটেছে। একটার পর একটা মৃত্যু। যেন এক দিন পর পর। মাত্র পনের দিনের মধ্যে ঘটে ছিল এ তিনটি ঘটনা। ২০০৪ সালের ৬ই আগষ্ট সন্তোষ দা, ১৩ই আগষ্ট হুমায়ুন আজাদ আর ২১শে আগষ্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশ। প্রত্যেকটির জের ছিল মাস জুড়ে। মৃত্যু সংবাদ বহনকারী প্রতিবেদক বলে ডাকলেন দু’একজন সহকর্মী। বারণ করলেন নীল শার্টটা পরতে।
এরও চার বছর পর এই আগস্টেই চলে গিয়েছিল আমার আম্মা। দুনিয়া আর আমাদের মায়া ছেড়ে। প্রথম মৃত্যুর শোক ভুলিয়ে দেয় পরের মৃত্যু। শোকে বিহ্বল হওয়ার সময় নেই। শুধু নতুনের পেছনে ছোটা। পুরানো নিয়ে মাতম করতে গেলেই নতুনের সাথে পরিচয় হয় না। আর নতুনের সাথে পরিচয় না হলে লোকে সাংবাদিকও বলে না। হুমায়ুন আজাদের মরদেহ যেদিন দেশে আনা হয়েছিল সেদিনও আমার এ্যাসাইনমেন্ট ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ তারপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। রাস্তাজুড়ে পুলিশের পাহারা। মসজিদে শেষবারের মত কফিনের ভেতর থেকে তার ঔষধ মাখানো মুখটা দেখেছিলাম। কফিন খোলার পরের গন্ধটা বেশি দিন মনে রাখতে পারিনি। আর দশটা গন্ধের সাথে মিশে গেছে। স্মৃতি খুঁড়ে বের করতে হয় পোস্তগোলার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘটনা। যোগ দিতে পারিনি সন্তোষ দা’র শ্রাদ্ধে, হুমায়ুন আজাদের কুলখানিতে। শুধু নতুন খবর আর নতুন খবর। উপায় নেই কোন একটা বিষয় নিয়ে বসে থাকার। শহরের মানুষ চাঁদ দেখে। আলোর ভিড়ে আর জোসনা চোখে পড়ে না।
আমরা যারা সাংবাদিক তারা শুধু ঘটনা দেখি। তা নিয়ে ভাবনার সুযোগ কম। মনে দাগ কেটে রেখে দেয়ার সুযোগ কম। একটা ঘটনা আর একটা ঘটনাকে ঢেকে দেয়। ভাবনার আগেই দখল করে ফেলে নতুন ঘটনা। তবু কিছু ঘটনা অজান্তে মনে থেকে যায়। মনে রাখতে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)