ওয়ালটনের পণ্যের মান, দেশি না বিদেশি, সাংবাদিকতা, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও হয়রানি বিষয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আলোচনায় সবগুলো বিষয়কে একপাল্লায় তুলে নিয়ে অনেকেই পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অথচ ক্ষুদ্র বিবেচনা এতগুলো বিষয় এক নিক্তিতে তুলে নেওয়া সমর্থন করছে না।
সাংবাদিক আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে ওয়ালটন চাঁদাবাজি মামলাসহ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেছে। আহমেদ রাজু জামিন পেয়েছেন আদালতে, এটা সর্বশেষ খবর। আরও এক খবর হচ্ছে সরকার হয়ত আইনের এ ধারা বাতিল করতে যাচ্ছে। কিন্তু ৫৭ ধারা বাতিল হলে নতুন যে আইন আসছে সে সম্পর্কেও উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক ওয়ালটন, সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও ৫৭ ধারার প্রয়োগ আলোচনার এ পর্যায়ে নতুন সময় ডটকমের বিরুদ্ধে অনেকেই উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগ তুলছেন। অনেকেই ওয়ালটনের পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ কেউ আবার ওয়ালটন দেশি, নাকি বিদেশি পণ্য এনিয়ে বাহাসেও লিপ্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থায় সবগুলো বিষয়কে নিয়ে আলোচনা শুরু করে কোন পক্ষেই অবস্থান নেওয়াকে যৌক্তিক মনে হয় না। কারণ এখানে এতগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আদতে আমরা আলোচনার লক্ষ্যচ্যুতই হচ্ছি।
ওয়ালটনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন যদি মিথ্যা হয় তাহলে তাদের সামনে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা আইনের আশ্রয়ের নামে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা কি আইন নয়। হ্যাঁ, এটাও আইন, তবে এটা পুলিশ-র্যাবের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ভাষ্যমতে ‘বন্দুকযুদ্ধ, অথবা ক্রসফায়ারের’ মত কথিত আত্মরক্ষার্থে এবং এতদসম্পর্কিয় শব্দগুলোর মতোই কতিপয় শব্দ-বাক্য। ৫৭ ধারাকে যতই আইনের মোড়ক পরানো হোক না কেন এটা হয়রানি ও প্রতিহিংসা চরিতার্থের একটা মোক্ষম দাওয়াই ছাড়া আর কিছু মনে করি না, ব্যক্তিগতভাবে; যা স্বয়ং আইনমন্ত্রীও ঘুরিয়েফিরিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন।
ওয়ালটন সাংবাদিক আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার নামে আইনের দোহাই দিয়ে আক্রমণের আশ্রয় নিয়েছে, যার সুযোগ করে দিয়েছেন এ আইনের প্রণেতারা। এটাকে ওয়ালটন কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক শায়েস্তার মিশন বললে কি ভুল বলা হবে? অথচ এখানে তারা ধৈর্য্যসহ সাধারণ আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন, আর এতে করে আমাদের সামনে তুলনামূলক আলোচনার সুযোগ থাকত যুক্তি ও বাস্তবতা-সহযোগে।
নতুন সময় ডটকম’র নির্বাহি সম্পাদক আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে ওয়ালটনের চাঁদাবাজি মামলাসহ ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের পর আমাদের অনেকেই ওয়ালটন পণ্যের মান এবং সেটা দেশি, নাকি বিদেশি এ নিয়ে আলোচনা করছেন। এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমে অনেকেই নিজেদেরকে কোন একটা পক্ষে দাঁড় নিয়েছেন। তবে আমার কাছে ঠিক এই সময়ে পণ্যের মান এবং দেশি-বিদেশি আলোচনাকে কার্যকর কিছু মনে হয়নি। হতে পারে ওয়ালটনের মান জাপানি প্রযুক্তির চাইতেও উন্নত এবং শতভাগ দেশি; কিন্তু প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য, মামলায় হয়রানিমূলক ধারার আশ্রয় নেওয়ার এ পর্যায়ে পণ্যের মান আর দেশি-বিদেশি প্রযুক্তির ওইসব আলোচনা সময় উপযোগি নয়।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার জন্ম হওয়ার সময় থেকেই এ আইনের উদ্দেশ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব উল্লেখপূর্বক ব্যক্তিগতভাবে এর বিরোধিতা করে আসছি। আগের সে অবস্থান থেকে এখনও সরে আসিনি যৌক্তিকভাবেই। সেক্ষেত্রে এ আইনের মাধ্যমে যারা অন্যকে হয়রানি করে আসছে তাদের বিরুদ্ধেও প্রাথমিক অবস্থান নেওয়াটা কর্তব্যজ্ঞান করছি। কোনভাবেই এ আইনকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নেই। সে হিসেবে ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ যে ভূমিকা রেখেছে সেটাকে সমর্থনযোগ্য বলে মনে করি না। প্রতিবেদন যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে তারা প্রচলিত আইনে এর মোকাবেলা না করে বিতর্কিত এক আইনের আশ্রয় নিয়ে উচিত কাজ করেনি।
নতুন সময় ডটকম সাংবাদিকতা করেছে, নাকি ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটিয়েছে- এ নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে তাদের পাঠক। প্রত্যেক পাঠকের ব্যক্তিগত চিন্তা, তুলনামূলক বিচারের ক্ষমতা ও সক্ষমতা রয়েছে বলেই মনে করি। সকল পাঠক না হলেও বেশিরভাগ পাঠকই যেকোন প্রতিবেদনের ভিত্তি ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনার ক্ষমতা রাখে। অগণন না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠকের সে ক্ষমতা রয়েছে বলে এখনও সহস্রাধিক মিডিয়ার ভিড়ে হাতেগোনা কিছু মিডিয়া রেফারেন্স হয়। এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। যেখানে পাঠকই সংবাদমূল্য, ভিত্তি ও গ্রহণযোগ্যতার নির্ণায়ক সেখানে তাদের ওপর ভরসা রাখতেই হয়।
ওয়ালটন, ৫৭ ধারা ও সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের এ আলোচনা যখন চলমান তখন অন্য এক অনুষ্ঠান কিংবা ব্রিফিংয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৫৭ ধারা বাতিলের কথা জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর অনেকেই বরাবরের মতোই আশাবাদী হচ্ছেন। কিন্তু ৫৭ ধারা নিয়ে আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রথমবার যে এসেছে তা নয়। এর আগে একাধিকবার তিনি ৫৭ ধারার বাতিল, বিলোপ ও সংস্কার নিয়ে কথা বলেছিলেন। প্রতিবারই আমরা অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলাম, এবারও হচ্ছি; হয়ত একই ধরনের বক্তব্য আগামিতে দিলেও একইভাবে আমরা আশাবাদী হবো। আমরা আশাবাদী হওয়ার দলে নাম লিখিয়েছে আগেই, তাই যতবার এমন কথা বলবেন ততবার আশাবাদী হতেই থাকব।
সর্বশেষ, বুধবার (৩ মে) সচিবালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাটের বৈঠকের পর মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন: বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় যেসব সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা আছে তারা ন্যায়বিচার পাবেন।’ তিনি তাঁর ওপর আস্থা রাখতেও বলেন সাংবাদিকদের। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার যেসব অসঙ্গতি আছে তা সংশোধন করা হবে। আইসিটি বিষয়ক অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে নতুন আইন করা হচ্ছে যা আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে আছে। নতুন আইনে মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় বলে মনে করছেন আইনমন্ত্রী। এর আগের দিন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনেও ভয় ও দমনের বেড়াজালে বাংলাদেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে উল্লেখ করেছে। অ্যামনেস্টি দাবি করেছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গণমাধ্যমে তার সমালোচনা ঠেকাতে নানা হস্তক্ষেপের পাশাপাশি কালাকানুনও ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ সরকার সাংবাদিকতার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যেন মতপ্রকাশ একটা অপরাধ, দাবি অ্যামনেস্টির।
দেরিতে হলেও সরকারের আইনমন্ত্রীর ৫৭ ধারা নিয়ে এমন বক্তব্য আশাবাদি হওয়ার পাশাপাশি প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কারণ কেমন হবে সে আইন তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনাও হয়নি, হচ্ছে না।
ওয়ালটন, নতুন সময় ডটকম- এই আলোচনার এ পর্যায়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ। আলোচনার প্রায়োরিটি হচ্ছে এই বিতর্কিত আইন। এ পর্যায়ে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগকারী ওয়ালটনকে তাই ব্যক্তিগতভাবে ছাড় দিতে রাজি নই। প্রতিষ্ঠানটি যদি ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ না করে সাধারণভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে নামত তাহলে তাদের পণ্যের মান, দেশি-বিদেশির স্বরূপ নিয়ে আলোচনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণও ভাবতাম; কিন্তু তারা সে সুযোগ রাখে নি।
এ পর্যায়ে তাই সকল আলোচনা ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে। এখানে আমি বিচারক নই, তাই দোষগুণ নির্ধারণে যাচ্ছি না; এখানে আমি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বাতিলের দাবির এক সমর্থক, তাই আমার সকল দৃষ্টি এ আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)