লেবানন ইস্যুতে ইসরায়েল তার বিদেশী দূতাবাসগুলোকে স্ব স্ব দেশে সৌদি আরবের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ভূমিকা রাখার নিদের্শ দিয়েছে। দেশটিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ইসরায়েলের স্পষ্ট প্রচেষ্টারও ইঙ্গিত দিয়েছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক কূটনৈতিক তারবার্তা।
আলজাজিরা জানায়, ফাঁস হওয়া তারবার্তা অঞ্চলটিতে উত্তেজনা সৃষ্টির ইন্ধন জোগাতে ইসরায়েল-সৌদি আরব আঁতাতের গুজবকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলো।
চলতি সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাঠানো তারবার্তাটি ফাঁস করে ইসরায়েলের চ্যানেল ১০ নিউজ। ওই বার্তায়, ‘আঞ্চলিক অন্তর্ঘাতে’ ইরান ও হিজবু্ল্লাহ’র সংশ্লিষ্টতার উপর জোর দিতে রাষ্ট্রদূতদের চাপ দেয়া হয়। রিয়াদও ঠিক একই অভিযোগ কদিন ধরেই করে আসছে।
কয়েকজন আরব বিশ্লেষক বলছেন, সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপে ইসরায়েলের কূটনৈতিক এই তৎপরতা ‘অত্যন্ত বিরল’ ঘটনা।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের উপদেষ্টা ইয়োসি আলফার এই তারবার্তাকে ‘চরম ঔদ্ধত্য’ বলেছেন।
বিশ্লেষকদের ধারনা, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, একই সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই অঞ্চলের অস্থিরতার সুযোগে কিছু লাভ করতে চাইছেন।
লেবাননের সাম্প্রতিক সংকট:
হিজবুল্লাহ সৌদি আরবের সাথে ‘যুদ্ধঘোষণা করেছে’ এমন দাবি করে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার তার নাগরিকদের দ্রুত লেবানন ছাড়তে বলে। এর আগে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগ করেন। সৌদির সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ থাকা হারিরি রিয়াদ থেকেই তার পদত্যাগের কথা জানান।
ইরানের দিকে অভিযোগ তুলে সেদিন হারিরি বলেন, শিয়া গ্রুপ হিজবুল্লাহর মাধ্যমে ইরান লেবাননে ‘রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র নির্মাণের’ অপচেষ্টা করছে। লেবাননের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে হিজবুল্লাহ’র, রয়েছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী।
অনেকেরই সন্দেহ, লেবাননকে অস্থিতিশীল করতেই হারিরিকে পদত্যাগ করতে বলেছে রিয়াদ। জটিল, নাজুক রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই জাতিগত বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয় লেবাননকে।
হিজবুল্লাহর প্রতি সৌদির আরও অভিযোগ, দলটি ইয়েমেন থেকে ইরান-নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিলো, যা রিয়াদ প্রতিহত করে।
ইয়েমেনে শিয়া সংখ্যালঘু হুতি বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত সৌদি। হুতিদের সাহায্য ও লালনে ইরানকে দায়ী করে দেশটি।
ফাঁস হওয়া তারবার্তা:
“হারিরির পদত্যাগেই স্পষ্ট, লেবাননের নিরাপত্তায় ইরান ও হিজবুল্লাহ কতটা ভয়ঙ্কয়’ বিষয়টিতে কূটনীতিকদের জোর দেওয়ার নির্দেশনা ছিলো তারবার্তায়।
লেবানন সরকার থেকে হিজবুল্লাহকে বিতাড়িত করতে স্ব স্ব দেশের ‘সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের’ চাপ দিতে আহ্বান জানানোর কথাও বলা হয়।
তারবার্তায় বলা হয়, “সরকারে হিজবুল্লাহর অংশগ্রহণ লেবাননকে স্থিতিশীল করে, এমন যুক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করে হারিরির পদত্যাগ।”
ইয়েমেনের যুদ্ধেও সৌদির সমর্থন আদায়ের নির্দেশনা ছিলো। এক্ষেত্রে রিয়াদকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার ঘটনা উল্লেখ করে, তা রুখতে “ইরান-হিজবুল্লাহ’র উপর আরও চাপ প্রয়োগের” কথাও বলা হয়।
“নেতানিয়াহু সম্ভবত চেয়েছিলেন তারবার্তাটি প্রকাশ্যে আসুক”
“নেতানিয়াহু সম্ভবত চেয়েছিলেন তারবার্তাটি প্রকাশ্যে আসুক।” তেল আবিবের বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক মেনাসেম ক্লেইনের এমন অভিমত।
আলজাজিরাকে তিনি বলেন, “তুমি যদি একটি কূটনৈতিক তারবার্তা পাঠাও এবং প্রতিটি বিদেশী রাজধানীতে লবিং শুরু করো, তোমাকে ধরেই নিতে হবে তা দীর্ঘ সময় গোপন থাকবে না।”
“নেতানিয়াহুর লক্ষ্য, সৌদির কাছে স্পষ্ট করা, যে তিনি সাহায্য করতে পারেন। বার্তাটি এমন ‘পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং ইরান-হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তোমার রাজনৈতিক লক্ষ্যের অগ্রযাত্রায় সাহায্য করতে পারি’।”
কেউ কেউ বলেন, হিজবুল্লাহর সাথে একটি অপ্রয়োজনীয়, বিপদজনক বিবাদে জড়াচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের বিশ্লেষক আমোস হালের যাকে বলেছেন “নতুন আঞ্চলিক বিন্যাস গড়তে রিয়াদের উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা’।
যুদ্ধক্ষেত্র সিরিয়া থেকে লেবাননে সরিয়ে নিতে চায় সৌদি
ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল শাপিরো দৈনিক হার্টজ-এ লেখা এক কলামে বলেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাতে ব্যর্থ হয়ে সৌদি চাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র সিরিয়া থেকে লেবাননে সরিয়ে নিতে।
ছয় বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়।
হিজবুল্লাহর সাথে সৌদির বিবাদে জড়িয়ে পড়ার প্রচেষ্টায় ইসরায়েলকে সতর্ক করেন শাপিরো, যা আঞ্চলিক যুদ্ধেরও রূপ নিতে পারে।
ইরানের পরমাণু চুক্তির অবসান চায় ইসরায়েল-সৌদি আরব
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা একটি সূত্র আলজাজিরাকে জানায়, ইউরোপে শরণার্থী নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। লেবাননের ক্ষমতার ভারসাম্যে কোন পরিবর্তন নতুন করে শরণার্থী ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল চাচ্ছে, ইউরোপ যেনো ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করে, বিশেষ করে ইরানের পরমাণু চুক্তির সাথে সম্পৃক্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলো। চুক্তিটির ফলে দুই বছর আগে ইরানের উপর কূটনৈতিক অবরোধ হালকা করা হয়েছিলো।
“ইসরায়েল ও সৌদি আরব দুটি দেশই চায় পরমাণু চুক্তি ভেঙ্গে যাক, কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে রিয়াদের চেয়ে ইসরায়েল অবস্থান বেশি শক্তিশালী।” সূত্রটি জানায়।
লেবানন কি অরক্ষিত?
বিশ্লেষকরা জানায়, হারির পদত্যাগে লেবাননের জাতিগত সংঘাত হলে তা দেশটিকে ইসরায়েলের আগ্রাসনের জন্য আরও সহজ লক্ষ্য করে তুলবে।
সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গত বিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া করে, হয়তো তা বিবাদে জড়ানোরই একটা প্রস্তুতি। এমন অভিমত অনেকের।
বহুল ধারণা, সহস্রাধিক রকেট ও মিসাইল রয়েছে হিজবুল্লাহর। ২০০৬ সালে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ ও লেবাননের হামলার পুনরাবৃত্তিতে যা প্রতিবন্ধক।
ইসরায়েলের সাংবাদিক নোয়াম শেইজাফ বলেন, সবাই চাচ্ছে অন্য কেউ যেনো তার হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা লড়ে দেয়। ইসরায়েল চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তা করে দিক, সৌদি আরব চাচ্ছে ইসরায়েলকে।
“সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের কাছে পরাজয়ের পর সৌদি আরব জানে, তাদের কাঙ্ক্ষিত সামরিক-কূটনৈতিক শক্তি ইসরায়েলই তাদের দিতে পারে, এমনটা ইসরায়েলও অবগত।
সম্প্রতি নেতানিয়াহু বলেন, ইরানকে মোকাবেলায় ‘আধুনিক সুন্নি রাষ্ট্রের’ সাথে মৈত্রি গড়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করছে ইসরায়েল।
‘সুন্নি বিশ্বের নেতা হয়ে উঠছে ইসরায়েল!’
ইসরায়েলের একজন বিশ্লেষক জেফ হালপার বলেন, “ইসরায়েলের আরও বড় ইচ্ছা আছে। এটা অদ্ভুত শোনালেও, এই তারবার্তা দেখায় ইসরায়েল কিভাবে সুন্নি বিশ্বের নেতা হয়ে উঠছে!”
“সৌদি দেখছে, তারা এমনকি ইয়েমেনে হুতিদেরও হারাতে পারছে না। ইসরায়েলের সাহায্য তাদের প্রয়োজন। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্যতা, মার্কিন কংগ্রেসে প্রভাব- আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলের সেই ক্ষমতা রয়েছে, যা সৌদি আরবের প্রয়োজন।”