চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তরুণ প্রজন্মের অনাস্থা-আস্থায় বিএনপির ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কি তরুণ প্রজন্মের আস্থা হারিয়েছে? অনেকে বিএনপির উপর আস্থা রাখলেও তরুণদের বড় অংশই বলছে, তারা দলটির উপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না। এজন্য নানা কারণের মধ্যে তারা নেতৃত্বের দুর্বলতা, তরুণদের স্বপ্ন দেখানোর মতো নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতি, জনবান্ধব কর্মসূচি না থাকা, আদর্শহীনতা এবং এখনো জামায়াতের সঙ্গে সংশ্রব রাখার কথা বলেছেন।

বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব অবশ্য এসব অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, কিছু সমস্যা থাকলেও বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থনের অভাব নেই। তরুণ প্রজন্মের কাছেও বিএনপি এবং বিএনপি নেত্রী আগের মতোই সমান জনপ্রিয়। তাদের দাবি, সরকারের দমন-নিপীড়নের কারণে বিএনপিকে আপাতঃ চোখে দুর্বল মনে হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বিএনপির জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

বিএনপি নেতাদের এ কথার সঙ্গে তরুণদের অনেকে একমত নন। তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মনিরুল হক আকাশ। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখার চেষ্টা করেন তিনি। আকাশের মতে, বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডই দলটির নাজুক অবস্থা প্রমাণ করে।

‘বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলে মনে হয় না,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন: বিএনপির আবারও ক্ষমতায় আসতে ৩০/৪০ বছরও লেগে যেতে পারে। যদি ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব তৈরি হয় এবং ‘ভিশন’ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

তবে, এসব শর্ত পূর্ণ ছাড়াও বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আমজাদ হোসাইন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সব সম্ভবের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী তাসনিম ফারিয়াও মনে করেন, এদেশের মানুষের মনোভাব বোঝা মুশকিল। আগামী নির্বাচনে যদি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে পারে তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।

একইরকম মন্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাতের। ‘আসলে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব বোঝা কঠিন। যদি ঠিকঠাক নির্বাচন হয় তবে দেখা যাবে ভিন্ন চিত্র। আমাদের জনগণের চিন্তা-চেতনা এখনো অতটা অগ্রসর নয়।”

তরুণ লেখক শাকির আহমেদ অবশ্য সাধারণের ‘চিন্তার’ উপর দোষ চাপাতে নারাজ। ‘জনগণকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আগে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ ঠিক করতে হবে। নিজেদের স্বার্থের গণ্ডি ছেড়ে আসতে হবে। সত্যিকার অর্থে মানুষের জন্য কাজ করার দৃঢ় মনোভাব দেখাতে হবে।’

এক্ষেত্রে বিএনপির দুর্বলতা কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং এন্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসির আরাফাত বলছেন, বিএনপির যে ঐতিহাসিক ভুল আছে তা দলটি স্বীকার করে না, এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। আর এ ভুল তারা করেই যাচ্ছে।

তিনি মনে করেন, মুসলিম লীগের মতোই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বিএনপি। এক্ষেত্রে তার বক্তব্য: বন্দুকের নল দিয়ে যে দল গঠিত হয় আর যাই হোক সে দল গণতান্ত্রিক নয়। আরাফাতের দাবি, বর্তমান প্রজন্মের কাছে দলটির মুখোশ উম্মোচিত হচ্ছে। তরুণরা নিজেদের স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতন। তারা জানতে শুরু করেছে কারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছে।

এসবের সঙ্গে বিএনপির ভুল কিংবা দুর্বলতা প্রশ্নে তরুণ রাজনৈতিক গবেষক ওয়াসিফ আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগে যেমন পরিকল্পিত গবেষণা হয় বিএনপিতে তেমন কোন গবেষণা হয় না। যদি সে রকম কোন গবেষণা থাকতো তাহলে দলটির এমন দুর্দশা হতো না।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ, ভিশন ২০২১ ও ২০৪১– এগুলো হচ্ছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ মিশন-ভিশন। আওয়ামী লীগের গবেষণার জন্য সিআরআই এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষক টিম রয়েছে,’ উল্লেখ করে ওয়াসিফ বলেন, ভবিষ্যতে ভালো করতে হলে ‘ভিশন থাকা চাই। এক্ষেত্রেও বিএনপির সংকট আছে।’

এরপরও বিএনপির জন্য আশার বাণী শোনাচ্ছেন ওয়াসিফ। ‘দেশে যেহেতু আওয়ামী লীগ আর বিএনপি ছাড়া কোন বড় দল নেই, তাই একটি দল দুর্বল হয়ে পড়লে অন্য দল ক্ষমতায় চলে আসবে– এটাই স্বাভাবিক।’

এ ভাবনা থেকে ওয়াসিফ মনে করেন, বিএনপি যে এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তা নয়। হয়তো দীর্ঘদিন ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিএনপির পরবর্তী প্রজন্ম হাল ধরতে পারে।

সেজন্য কি বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাইবা জামান এখানেও বিএনপির সমস্যার কথা বললেন। ‘একটা সময় তারেক রহমানের প্রতি তরুণদের আগ্রহ ছিলো। সে তুলনায় সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন অপরিচিত মুখ। কিন্তু তারেক নিজেই নিজের অবস্থান হারিয়েছেন। অন্যদিকে জয় দেশের তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তরুণদের আইকনে পরিণত হচ্ছেন।’

শুধু তাই নয়, বিএনপি আদর্শিক সংকটেও আছে বলে মনে করেন তরুণদের কেউ কেউ। ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে চাকুরির অপেক্ষায় থাকা শেখ নূর কুতুবুল আলম বলেন, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির আদর্শের সংকট রয়েছে। জামায়াত সম্পৃক্ততার কারণে দলটির প্রতি তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণ কমে যাচ্ছে।

‘বিএনপি বা ছাত্রদল সমর্থক তরুণরাও বিএনপির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না,’ দাবি করে তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম দলটির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।

তবে আলম বলেন, দলটি যদি দৃশ্যমান নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে, যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত সম্পৃক্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার চেয়ে ভিশন সুনির্দিষ্ট করতে পারে তাহলে হয়তো কিছু আশা করা যেতে পারে।

তরুণদের ভাবনার বিপরীতে বিএনপির তরুণ নেতৃত্বের বক্তব্য
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তাক আহমেদ তরুণদের মন্তব্যের প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলেন। তবে তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে।

‘ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ জেগে উঠলে কোন অপশক্তি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। বর্তমান সরকার গায়ের জোরে টিকে আছে। গণতন্ত্রের লেবাস পরে স্বৈরতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে,’ দাবি করে তিনি বলেন: একটি বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে জনগণকে চাপে রেখে কাজ করছে সরকার। এখানে জনমতের কোন প্রতিফলন নেই।

তবে, মোস্তাক আহমেদ মনে করেন, এটি সাময়িক ব্যাপার। ‘জনগণ ফুঁসে উঠলে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’

বিএনপিরও গবেষণা কার্যক্রম আছে দাবি করে তিনি বলেন: আমাদের জিয়া পরিষদ আছে। এছাড়া এমাজউদ্দীন স্যারের নেতৃত্বে বিএনপির ভেতরে নতুন চিন্তা এবং গবেষণা চলছে নিয়মিত।

বিএনপি ভিশনারি দল নয়– তরুণদের এমন অভিযোগের উত্তরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সহ দপ্তর-সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন: অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ভিশন ও স্বপ্নই দেখা যায়। কিন্তু জনগণের মুখোমুখি হলে এসব ভিশন কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে তা দেশবাসী দেখতে পাবে।

তিনি বলেন, বিএনপির লক্ষ্য-কর্মসূচি আছে ১৯ দফায়। এই ১৯ দফায় সব মিশন-ভিশন আছে। ১৯ দফা ভালোভাবে দেখলে বিএনপির ভিশন, স্বপ্ন জানতে পারবেন। নতুন করে কিছু বলা লাগে না।