পরীক্ষা ভীতিতে রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত শিশুরা। অযথা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় অভিভাবকেরা। একাধিক গবেষণার ফলফাল বলছে, প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা শিশুদের মেধা বিকাশে কোনো কাজেই আসছে না। শিক্ষাবিদেরাও নানা যুক্তি তুলে ধরে বলছেন, এ পরীক্ষা পদ্ধতি শিশুদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বনাশা এ পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলের কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্নফাঁস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। তবু কেন এ পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে বা এখনও বাতিলের ঘোষণা আসছে না?
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন একজনকেও পাওয়া যায়নি যিনি এই দুটি পরীক্ষার পক্ষে। তাদের সবার দাবি শিক্ষার্থীদের বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি দিতে এবং অভিভাবকদের দুশ্চিন্তামুক্ত করতে অচিরেই বাতিল করা হোক এ পরীক্ষা। সেদিন উদয়ন স্কুলের সামনে কথা হচ্ছিল একজন অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, আমি বুঝতে পারি না এই পরীক্ষাটা নেওয়ার দরকার কি? সন্তানদের আতঙ্কগ্রস্ত করা এবং আমাদের উদ্বিগ্ন করা ছাড়া এ পরীক্ষাতো আর কিছুই দিতে পারছে না। তবে কেন অযথাই এ পরীক্ষা নেওয়া?
২০১৫ সালে গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। পাসের হার বাড়াতে খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে।
পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা এবং উত্তরপত্র মেলানোর জন্য শেষের ৪০ থেকে ৬০ মিনিট অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে, পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইডবই। শিশুরা শেখার আনন্দ পেতে এবং সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রখ্যাত দুই জন শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও বলেছেন, এর মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার বদলে পরীক্ষা নির্ভর একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এই পরীক্ষার নেয়া সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত এবং অদূরদর্শী উল্লেখ করে এ দু’জন শিক্ষাবিদ বলছেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষাভীতি ছড়িয়ে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় এ পরীক্ষা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ এ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছেন।
যাদের জন্য পরীক্ষা এবং যারা যারা এ পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাই যখন এ পরীক্ষা বাতিলের দাবি করছেন তখনও সরকারের পক্ষ থেকে কোন ঘোষণা আসছে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা চলতে থাকবে।
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ যত দ্রুত সম্ভব সর্বনাশা এ পরীক্ষা দুটি বাতিল ঘোষণা করে শিশুদের রেহাই দিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)