বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কারে একটি দরকারি ও প্রশংসনীয় উদ্যোগের কি দুর্গতি হয়েছিল সেই গল্প দিয়ে শুরু করি।
১৯৭৮-৭৯ সালের ঘটনা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শিক্ষা সংস্কারে আন্তরিকভাবেই উদ্যোগী হলেন। এসএসসি পর্যায়ে ‘নিরক্ষরতা দূরীকরণ’ বিষয়ক একটি ব্যবহারিক ক্লাস বাধ্যতামূলক করলেন। পাশের নিয়ম করা হলো যে ক্লাস নাইনে উঠা প্রত্যেক ছাত্র তার পরিবার বা প্রতিবেশিদের মধ্য থেকে একজন করে নিরক্ষর মানুষ খুঁজে করবে। তারপর নিরক্ষর মানুষটিকে অক্ষর ও সংখ্যাজ্ঞান দিবে। পত্রিকা পড়তে, চিঠি লিখতে এবং হিসাবনিকাশ লিখে রাখতে সক্ষম সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠায় সাহায্য করবে। নইলে এসএসসি ডিগ্রী মিলবে না।
খুবই সহজ কাজ। ছাত্রছাত্রীদের আনন্দের সঙ্গেই করতে পারার কথা। কিন্তু বাংলাদেশিদের দুই নম্বরি বুদ্ধি উদ্যোগটিকে অল্প সময়ের ব্যবধানেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলল। ছাত্রছাত্রীরা এসএসসি পরীক্ষার সময় আগে হতেই সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কাউকে ভাড়া করে নিয়ে যেত তার হয়ে প্রাক্তন নিরক্ষরের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। এই অপকর্ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ল অভিভাবক-শিক্ষক-ছাত্রসহ সমস্ত মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে মানবিক শিক্ষা-সংস্কারের আরো কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্কুলের লাইব্রেরি বাধ্যতামূলক করলেন, অনুদান বাড়ালেন। প্রতি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিদিন পালা করে অন্তত এক ঘন্টার একটি লাইব্রেরি ক্লাস, সাপ্তাহিক বই ধার এবং তা পাঠ করা বাধ্যতামূলক করা হলো। মিলনায়তন সংস্কার ও ব্যবহারের বরাদ্দ বাড়ল। শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর স্কুলগুলোকে শিশু একাডেমির নেটওয়ার্ক-এর অংশ করা হলো। শিশু সংগঠন এবং শিশুনির্ভর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নানারকম প্রনোদনা ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই কার্যকর হয়নি। গলদ গোড়াতেই। মূল সমস্যা স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে। তাদের প্রশিক্ষণগুলো প্রাগৈতিহাসিক, ম্যাড়মেড়ে ও সেঁকেলে। ফলে তাদের মোটিভেশন আটকে থাকতো প্রমোশন ও টিউশনির অতিরিক্ত আয়ের মধ্যে। ছাত্রছাত্রীদের মানবিক বিকাশের জন্য নতুন নতুন রাস্তা খুঁজে বের করার শিক্ষকসুলভ তাগিদ তাদের মধ্যে তখনো ছিলনা এখনো নাই।
নোয়াখালি জিলা স্কুলে পড়তাম। ক্লাস নাইনে উঠে মানবিক বিভাগে পড়বো ঠিক করি। এটা জেনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাহেব আমাকে এবং আমার বাবাকে ডেকে পাঠালেন। আমার বাবাও একই স্কুলের শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক মহোদয় সবিশেষ আশ্চর্য ভঙ্গিতে আমার বাবাকে বললেন- এটা কি করছেন? ডাব্বা ছাত্রছাত্রীরা পড়বে আর্টস-এ। শুধু অংকে কাঁচা বলেই ওকে আর্টস পড়িয়ে ওর সামনের জীবনটা বরবাদ করে দিবেন তো? আমার বাবা অসাধারণ মৃদুভাষী ও তর্কবিতর্ক এড়িয়ে চলা বিনয়ী মানুষ হবার পরও সেদিন ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। সরাসরি মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন- ছেলের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে! তর্কে নেমে পড়েছিলেন। মুখের উপর যা বলেছিলেন তা অনেকটা এই রকম- অভিভাবকদের দায় কম, নিরানব্বই ভাগ শিক্ষকই এই রকমটি ভাবেন এবং অভিভাবকদের একই রকম ভাবতে বাধ্য করেন বা তাদের ভাবনাকে প্রভাবিত করেন।
২০০৬ সালের দিকে একবার বাংলাদেশের ‘স্কুলে কর্পোরাল পানিশমেন্ট’ বা ছাত্রছাত্রীদের মারধর করা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। খেয়াল করলাম শিক্ষকদের বড় অংশই ক্লাসে পাঠদানের বাইরে অন্য কোনো মানবিক চর্চায় ব্যপক অনীহা, অনাগ্রহ ও বিরক্তি দেখাচ্ছেন। ফোকাস গ্রুপে একদল শিক্ষক প্রায় সমস্বরেই অভিযোগ করলেন সরকার ক্লাসরুমের বাইরে একটি এক ঘন্টার সৃজনশীল না কি যেন মাঠকর্ম ক্লাস জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাইরে এটা-ওটা কিছু হাতে-কলমে করতে গেলে অভিভাবকরা লাঠিসোটা নিয়ে মারতে আসে। শিক্ষকদের নাজেহাল করে ছাড়ে। অভিভাবকরা অভিযোগ করেন পড়াশোনা ছেড়ে মাঠে ঘাস-লতাপাতা টানাটানি করার জন্য তারা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাননি। এদিকে অভিভাবকদের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সকলেই সমস্বরে অভিযোগটি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন এটি বাজে অজুহাত! দু’একজন অভিভাবক না জেনেবুঝে তেমনটি করে থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্ত হাতেগোনা দু’একজন অবুঝকে বুঝিয়ে বললেই হয়। কাজটি সহজ।
গত কিস্তিতে লিখেছিলাম ‘মানবিক শিক্ষার কোনো আমেরিকা-এশিয়া নাই’। সেখানে উল্লেখ করেছিলাম, এখন আবারও বলছি যে বাংলাদেশের স্কুলে প্রচলিত মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজনগুলো অনাবশ্যক ও অনর্থক যা সমাজে শিক্ষা বৈষম্য এবং শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ‘ভালো ছাত্র-খারাপ ছাত্র’ ধরণের বিভাজন তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আগে এইরকম কোনো বিভাজন না থাকার উন্নত দেশের পদ্ধতিটি বাংলাদেশেও অনুকরণীয় হওয়া দরকার। নইলে একমুখী ভাবনার জগদ্দল পাথরটি সরবে না। মানবিক শিক্ষা যে সুযোগ নয় অধিকার সে ধারণাটিও প্রতিষ্ঠিত হবেনা। উন্নত দেশগুলো উন্নত কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে নতুনতর ও আনন্দদায়ক কিছু যোগ হচ্ছেই। যোগ করছেন এবং উদ্ভাবনগুলোও করছেন মূলত শিক্ষকরাই। HEART ধারণাটি দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে বিশ্বময়। পাঁচটি শব্দের অদ্যাক্ষর দিয়ে গড়া এই HEART ভাঙলে পাই Humanities Education And Rights Training. ইউনিসেফও ধারণাটি গ্রহণ করেছে। হার্ট এর সারকথা দুইটি। এক, শিক্ষা সুযোগ নয়, সকল মানুষের সর্বজনীন অধিকার। দুই, শিক্ষাকে অবশ্যই মানবিক শিক্ষা বা মানবাধিকারের প্রশিক্ষণ হতে হবে। পশ্চিমে শিক্ষাজগতে দুই ধরণের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। এর একটি ‘Back to the basics’ অথবা ‘back to the roots’ বা ‘চলো শিকড়ে ফিরি’। অন্যটি ‘Humanities at the heart of education’। অর্থাৎ মানবিকীকরণই শিক্ষার প্রাণ। দুইটি ধারণাই একটি অপরটির পরিপূরক। উভয়টিরই মূল প্রতিপাদ্য ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
হার্ভার্ড-এর হেলেনিক স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা গ্রীক ধ্রুপদিতত্ত্ববিশারদ ও সফোক্লিস-বিশেষজ্ঞখ্যাত শিক্ষাচিন্তক বার্নার্ড নক্স মানবিক শিক্ষাবর্জিত জ্ঞানকে বেদরকারিই নয়, রীতিমত ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করেন। গ্রীক দর্শন ও সমাজচিন্তার তিন প্রতিপাদ্য ‘টেকনি’, ‘এপিস্টেমি’, এবং ‘স্কলি’ ব্যাখ্যায় আজো তাকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিস্কার ও ডিজিটাইজেশনের ফলে শিক্ষায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার প্রযুক্তি, স্মার্টবোর্ড ইত্যাদির ব্যবহারের তিনি বিরোধি ছিলেন না। কিন্তু দুনিয়াজোড়া শিক্ষাজগতের জন্য, এমনকি হার্ভার্ডের জন্যও তার একটি নিয়মিত সতর্কবাণী ছিল। বিশ্লেষণ করেই বলতেন- আমরা ‘টেকনি’ বা প্রায়োগিক দক্ষতাকে ‘অবেজক্টিভ’ বা বিজ্ঞানসিদ্ধ জ্ঞানচর্চা বলে বলে বিজ্ঞান শিক্ষণ বা কৃৎকৌশল-দক্ষতায় কতইনা জোর দিই। অথচ গ্রীক ‘টেকনি’ আসলে জ্ঞানের সর্বনিম্ন ধাপটি মাত্র। এমন কি ‘স্কলি’ বা হাসি-তামাশা-খেলাধুলা-ছুটিছাটা-ভ্রমণে আনন্দ করার মধ্য দিয়ে শেখাও ‘টেকনি’র উপরের ধাপ। আমরা গ্রীক ‘ফিলসফার কিং’ ধারণাটিকে ভুলভাবে আমলে নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা শিখাই যে গ্রীক দর্শনে বলা হতো জ্ঞানার্জন অভিজাতদের বিষয়, আমজনতার জন্য দরকারি নয়। আসলে ‘স্কলি’ বা নৈমিত্তিক জীবনের নির্যাসে জীবনঘনিষ্ট শিক্ষায় আমজনতাই আগানো থাকে। শিক্ষায় আমজনতার ‘স্কলি’র সঙ্গে ‘টেকনি’র সমন্বয় ঘটলেই ‘এপিস্টেমি’ হয়। ‘এপিস্টেমি’ উপরের ধাপ বটে, কিন্তু এটিই প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের শেষ সীমানা এমন কথা আসলে কোনো গ্রীক দর্শনেই বলা নাই।
ইংরেজি ‘নলেজ’ বা বাংলায় ‘জ্ঞান’ শব্দ দিয়ে ‘এপিস্টেমি’কে আধাআধি মাত্র বুঝা যায়। ‘অভিজ্ঞান’ শব্দটি খানিকটা উপযুক্ত। ‘অভিজ্ঞান’ ধরলে এপিস্টেমি জীবন-অভীক্ষা। জীবন হতে হাতে কলমে শেখা। শুধুই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। নক্স এর স্পষ্ট ভাষ্য— “The Greeks relegated practical skills, techne, to a lower sphere; the ideal of a free man was leisure, schole and the pursuits which permitted it. But the modern world has turned techne into a prodigious instrument for scientific investigations and material progress- only to discover not, we hope, too late that it is also a monster which may destroy all life on the planet.” আধুনিক বিশ্ব ‘টেকনি’কে এমনই লাগামছাড়া মাত্রায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার কলকব্জা বানিয়ে বস্তুগত সমৃদ্ধিতে নেমেছে যে এটি দেখা যাবে এক সময় এই গ্রহটিকে ধ্বংসকারী দানবে পরিণত করেছে।
নক্স এর এই শক্ত কিন্তু সুচিন্তিত সতর্কবাণীটি বিবেচনায় নিয়ে উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুত মানবিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে পড়ছে শ্রেণীকক্ষের বাইরে বৃহত্তর সমাজের মধ্যে। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে নেমে সামাজিক দায়িত্ব করার মধ্য দিয়ে ‘টেকনি’ এবং ‘স্কলি’র সমন্বয় বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশ চলছে উল্টো চালে। হাঁটছে বিমানবিকীকরণের পথে। স্কুল পাঠ্যক্রম হতে সুকুমার চর্চা সংগীত, চিত্রাংকন, নাট্যকলা, নৃত্যকলা তুলে দেয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষার দুর্নীতি, অনৈতিক পদ্ধতিতে পাশের হার বাড়ানো, কোচিং সেন্টার নির্ভরতা বাড়া- এইসব বন্ধের চেষ্টাটি নেই। এভাবে মানবিক মূল্যবোধ সংযোগহীন শিক্ষার কুফল বাংলাদেশের সমাজে এখনই নানাভাবে চোখে পড়ছে।
এই প্রলয়কালেও বাংলাদেশের শিক্ষাজগত, নীতি-নির্ধারকগণ এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ নির্বিকার। তারা অন্ধ সাজছেন। তারা জানেন, তবুও মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে অন্ধ সাজলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)