২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এবং একই সঙ্গে বিশ্বের দায়িত্ব নেবেন। আমেরিকায় তার ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। বিশ্ববাসীও এক ধরনের শঙ্কা ও ভয় নিয়ে প্রহর গুণছে ট্রাম্পযুগে প্রবেশ করার। দায়িত্ব গ্রহণের আগে প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোয় যাদের নাম তিনি ঘোষণা করেছেন, তাতেই বিশ্ববাসী চমকিত হয়েছেন।
এ তালিকায় একদিকে যেমন আছেন বিলিয়নেয়ার, পাগলাটে জেনারেল, তেমনি আছেন একসময়ের কট্টর ট্রাম্পবিরোধী ব্যক্তিও। তবে তাদের অধিকাংশই কট্টর রক্ষণশীল।
একজন ইসলামবিদ্বেষী, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবক্তা, একদা দায়িত্বজ্ঞানহীনতাবশত পদচ্যুত কূটনীতিককে দেশের পররাষ্ট্র সচিব পদে বসানো, না কি এক প্রবল গোঁড়া ব্যবসা-স্বার্থান্ধ পরিবেশচুক্তি-বিদ্বেষীকে পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা রূপে নিযুক্ত করা কোনটি বেশি বিপজ্জনক?
না কি অযোগ্য বিচারককে সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস নিয়োগ করা ততোধিক ভয়ানক? ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বিবেচনা বলতে এখন এইটুকুই। নির্বাচনের ফল স্বীকার করা ছাড়া গণতান্ত্রিক দেশের কিছু করার নাই এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যে নিজের প্রশাসন তৈরি করে নেবার ক্ষমতা রাখেন, তাও অস্বীকার করা চলে না। সুতরাং উপরের সিদ্ধান্তগুলির কোনওটিই পরিবর্তন করবার সাধ্য মার্কিন নাগরিকদের নাই।
তারা কেবল কেবল দাঁতে দাঁত চেপে হিসাব করতে পারেন, কোনটির জন্য তাদের বিপৎকাল অধিক মাত্রায় ত্বরান্বিত হচ্ছে। বাস্তবিক, ট্রাম্পের ক্যাবিনেটের এক পর এক নিয়োগ-সংবাদ শুনে কেবল মার্কিন দেশে নয়, গোটা বিশ্বেই আতঙ্কমিশ্রিত চমক সৃষ্টি হয়েছে। প্রার্থী হিসাবে ট্রাম্প অনেক আবোলতাবোল বকে ছিলেন, অসম্ভব প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা বলেছিলেন, সবই ঠিক। কিন্তু অনেকেই ভেবেছিলেন, নির্বাচনী প্রচারে অমন কথার কথা কতই হয়। কিন্তু জিতে এসে যে সেই আবোলতাবোলকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতা দেবেন, এতখানি আশঙ্কা করা হয় নাই।
সুতরাং ট্রাম্পের বিজয় সংবাদের অপেক্ষাও বড় দুঃসংবাদ ট্রাম্পের সচিব ও অন্যান্য সহকর্মী নির্বাচনের ঘোষণাগুলি। ট্রাম্প বিষয়ে যে আশার ছলনায় এত দিন নিজেদের ভুলানো হচ্ছিল, আপাতত ট্রাম্প প্রস্তাবিত মুখ্য উপদেষ্টা স্টিভেন ব্যানন ও জাতীয় নিরাপত্তা সচিব মাইকেল ফ্লিন সম্পর্কেও একই ছলনায় ধরে নেওয়া যাক, ব্যানন ও ফ্লিন যেভাবে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়িত হবে না।
ইসলাম ধর্মকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করে তার মূলোৎপাটনের যে ডাক দিয়েছেন, বালখিল্যতা হিসাবে তা গণ্য হবে। মেক্সিকো সীমান্তে ব্যানন যে প্রাচীর গাঁথবার আশা ব্যক্ত করেছেন, তা সম্ভব হবে না। মস্তিষ্কপ্রসূত যেসব উদ্ভট ও ভয়ানক তথ্য প্রচারে ফ্লিন অত্যুৎসাহী, তার কাছের লোকেরাই যার নামকরণ করেছে ‘ফ্লিন ফ্যাক্ট’ তিনি সচিব হলে সে সব বন্ধ হবে!
একইভাবে আশা থাকল, মার্কিন পরিবেশ রক্ষা দফতরের ভার পেয়েছেন যে স্কট প্রুইট এবং ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টিরিয়র এর দায়িত্ব পেয়েছেন যে ক্যাথি ম্যাকমরিস রজার্স, উভয়ই বিশ্ব উষ্ণায়নকে হাসির বস্তু ভাবলেও তারা সত্যই প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনবেন না।
পরিবেশ আইন না মেনে যত্রতত্র কারখানা প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হবেন না। কিংবা বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান আমেরিকা তথা বিশ্বের পরিবেশ পরিস্থিতির যে প্রভূত উন্নতি ঘটাবার সম্ভাবনা দেখিয়েছিল, সেই পরিকল্পনাকে টান মেরে ফেলে দেবেন না। এই সব কাজ সত্যিই করলে ২০৫০ সালেই পৃথিবী বাস-অযোগ্য হয়ে পড়বে, কেননা চিনের পরই গ্রিনহাউস উৎপাদনে আমেরিকা দ্বিতীয়। তার পথ-পরিবর্তন ভিন্ন এই গ্রহের ভাগ্য পরিবর্তন অসম্ভব। কিন্তু শঙ্কা একটাই, তারা যদি না বদলান?
তবে বিশ্ববাসীর জন্য সবেচেয়ে উদ্বেগের কারণ হয়েছে ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে জেমস মাত্তিসকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণায়। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের পর ‘সেক্রেটারি অব ডিফেন্স’ই হলেন প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর মুখ্য নির্বাহী, নীতিনির্ধারক এবং সিদ্ধান্তদাতা।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই দেশটিতে প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার সহযোগীর একজন সেক্রেটারি অব ডিফেন্স (অন্য তিনজন হলেন সেক্রেটারি অব স্টেট, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সেক্রেটারি অব ট্রেজারি)।
এটা সবারই জানা, বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের চলতি মুরব্বিপনা জ্ঞানরাজ্যে তার শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি অনেকাংশে সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের কারণেও। সে কারণেই এককালের চার তারকা জেনারেল জেমস মাত্তিসের দেশটির ডিফেন্স সেক্রেটারি হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতোই মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক ভাবুকদের।
এই মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মূলে রয়েছে জেমস মাত্তিসের অতীত। তাঁর অতীত বলছে, ভবিষ্যতে তিনি যত দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্বে থাকছেন, তত দিন বিশ্বের ভবিষ্যৎ হবে ঝুঁকিপূর্ণ। জেমস মাত্তিস বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান ২০০৪ সালের ১৯ মে ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে মুকারাদেব এলাকায় এক বিয়ের আসরে গণহত্যা চালিয়ে।
৪২ জন বেসামরিক মানুষকে খামোখাই হত্যা করে মাত্তিসের সৈনিকেরা। যাদের মধ্যে ছিল ১৩ শিশুও। এভাবে মানুষ খুন করে, ইরাক ও আফগানিস্তানে বিশেষ ‘কৃতিত্ব’-এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘ম্যাড ডগ’ উপাধি পান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নির্বাচনী প্রচারকালে বহুবার মাত্তিসকে ম্যাড ডগ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘আমেরিকার শত্রু’দের বিরুদ্ধে ওবামার ‘লিমিটেড ওয়ার’ দৃষ্টিভঙ্গির কড়া সমালোচক ছিলেন এবং মনে করেন, আমেরিকাকে তার সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘টোটাল ওয়ার’-এ যাওয়া উচিত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে তেল কোম্পানি এক্সনমবিলের প্রধান নির্বাহী রেক্স টিলারসনকে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বেশ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত টিলারসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোর বিরোধী। শ্রমিকবান্ধব নয় বলে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী অ্যান্ড্রু পুজডারের বেশ পরিচিতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী শ্রমমন্ত্রী হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প।
আলাবামার সিনেটর জেফ সেশনস মার্কিন সিনেটরদের মধ্যে প্রথম ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানকারী জেফ পেয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ। বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জেনারেলকে প্রশাসনে নিয়োগ দেয়ায় ট্রাম্পের
পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি বেশ যুদ্ধংদেহী হবে বলেই বিশ্লেষকদের মত। সিআইএ ডিরেক্টর, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের পদ তিনটি যাদের দেওয়া হয়েছে তারা তিন জনই বিশেষত মুসলিমদের প্রসঙ্গে অত্যন্ত কট্টরপন্থী হিসাবে পরিচিত। কেউ প্রকাশ্যে ইসলামকে ‘ক্যানসার’র সঙ্গে বারংবার তুলনা করেছেন, কেউ বা মুসলিম অভিবাসীদের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন, কট্টর হওয়ার প্রতিযোগিতায় অন্যদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ বা। ফলে প্রত্যাশিত ভাবেই, আমেরিকায় এবং বিশেষত মুসলিম-বিশ্বে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।
সংশয় নেই, রাজনীতি-কূটনীতির জগতে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের এক আগন্তুক বিশ্ব জুড়ে, মার্কিন মুলুক জুড়ে তুমুল আশঙ্কার এক মেঘকে ঘনিয়ে আনতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছেন। দুটো বিশ্বযুদ্ধে অসীম ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে আসা এ পৃথিবী আজ অস্ত্র সংবরণের কথা বলে, সামরিক সংযমের আপ্রাণ প্রয়াস দেখায়, পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গড়ে তোলে। যে কোনও সভ্য, প্রতিগিশীল রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই মানসিকতাই কাম্য।
কিন্তু ট্রাম্পের অভিমুখ এ সবের ঠিক বিপ্রতীপে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অসীম ধ্বংসের এক পদধ্বনি যেন অমোঘ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে! অনেকেই সম্ভাব্য দুর্যাগের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন!
দায়িত্ব গ্রহণের পর আসলেই তিনি কী করবেন? নির্বাচনী প্রচার পর্বে যে সঙ্কীর্ণ কট্টর স্বর শোনা গিয়েছিল এই ধনকুবেরের গলায়, তার রূপায়ণ শুরু হবে? টানটান উত্তেজনা আর শঙ্কার মধ্যেই আমাদের আগামী দিনগুলো পার হবে? নাকি সব আশঙ্কাকে মিথ্যে প্রমাণ করে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পই ইতিহাস গড়বেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)